#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী
ভোরবেলা থেকেই মীর হাউজে এক ধরনের ব্যস্ততা।রান্নাঘর থেকে ডাইনিং, আবার ডাইনিং থেকে রান্নাঘর। একটানা এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন হালিমা বেগম। শুধু তিনি একা নন, পাশে আছে দু’জন পরিচারিকা। ষোল বছরের চঞ্চল রিতু, আর চল্লিশোর্ধ্ব অভিজ্ঞ বানি আপা। এদিকে আফরোজা শেখ ভোর সাতটাতেই বেরিয়ে গেছে আদালতের উদ্দেশ্যে। একটা জটিল কেস আছে, তার এই পেশা তাকে প্রায়ই ঘরের বাইরে আটকে রাখে। তাই স্বাভাবিকভাবেই, পুরো বাড়ির দায়িত্ব এসে পড়ে হালিমার কাঁধে।
হালিমা বেগমের শেকড়টা কিন্তু অনেক নিচে। নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবা-মা হারা মেয়ে। তবুও তার জীবনে আলো এসেছিলো এক সম্পর্ক থেকে, আসফাক মীরের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে। পরবর্তীতে সালমান মীর আর তার স্ত্রী শারমিন দাঁড়িয়ে থেকে, তাদের বিয়ে দিয়ে হালিমাকে আনেন এই বাড়ির ছোট বউ করে। সেদিন থেকে হালিমার জীবনে কষ্ট যেন দূরে সরে গেছে। সে শুধু একজন স্বামী নয়, একটা পরিবারও পেয়েছে। আসার পর থেকেই সংসারকে নিজের করে নিয়েছে হালিমা। রান্না করা তার নেশা, রান্নাঘর যেন তার রাজ্য। নিত্যনতুন রেসিপি ট্রাই করে সবার জন্য সাজিয়ে রাখে, আর তার হাতের স্বাদের প্রশংসায় মুখর থাকে মীর পরিবারের সবাই। more....
আজও ডাইনিং টেবিলে বসেছে মীর বাড়ির সদস্যরা। এক পাশে আমজাদ মীর, অন্য পাশে আসফাক মীর। দুজনের মাঝখানে খাচ্ছে আদিবা আর আহিয়া। হঠাৎ সিঁড়ি বেয়ে ঠকঠক শব্দ তুলে নেমে এলো এ বাড়ির ছোট ছেলে, চঞ্চল আর দুষ্টু আদিল মীর। চুল এলোমেলো, মুখভরা দুষ্টুমি। এসেই বসলো আহিয়ার পাশে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে, আহিয়ার প্লেট থেকে খপ করে একটা ডিম তুলে মুখে পুরে দিলো। আহিয়া তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো,
“আদিল্লার বাচ্চা!”
সাথে সাথেই পা দিয়ে এক ধাপ করে পাড়া দিলো।আদিলও কম যায় না। চুল টেনে ধরে বললো,
“শাকচুন্নি! আমারে মারলি কেনো?”
“তুই আমার ডিম খাইলি কেনো?”
আদিল ভীষণ নাটুকে ভঙ্গিতে থুতু ফেলার ভান করে বললো,
“ওয়াক্ক থু থু… আগে বলবি না এটা তোর ডিম! আমি তো মুরগির ডিম মনে করে খাইছি… ওয়াক্ক্ক থু!”
তার এমন কাণ্ডে আদিবা খিলখিল করে হেসে উঠলো।
কিন্তু আহিয়া রাগে কটমট করে তাকালো সেদিকে। এক হাতে কনুই চালালো আদিলের পেটে। আদিলও প্রতিশোধ নিলো আহিয়ার চুল খপ করে টেনে ধরলো। মুহূর্তেই দুজনের চুল টানাটানি শুরু হলো, কেউ কাউকে ছাড়ছে না। শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলেন হালিমা বেগম। আর টেবিলের মাথা থেকে কর্কশ স্বরে ধমক দিলেন আমজাদ মীর,
“কি হচ্ছে এসব! সকাল সকাল তামাশা না করলেই নয়? ছাড়ো একে অপরকে।”
“আগে ওরে ছাড়তে বলো! ও আগে ধরছে।”
“না, আমি ছাড়বো না। আগে তুই ছাড়।”
হালিমা বেগম তখন খুন্তি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“আদি! ছাড় তাড়াতাড়ি। না হলে এই খুন্তি দিয়েই পেটাবো।”
“আম্মু, আগে এই শাকচুন্নি আমারে মারছে। আমি ছাড়বো না।”
এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে নিশ্বব্দ পায়ে নামতে দেখা গেলো আদনানকে। পরিপাটি পোশাকে প্রস্তুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হবে। তাকে দেখা মাত্রই দুজনের চুল থেকে হাত ছেড়ে দিলো। চুলের গোছা ঠিক করতে করতে দু’জন চুপচাপ চেয়ারে বসে গেলো। মাথা নিচু করে খাবারে মনোযোগী হয়ে গেলো যেন কেউ কিছুই বোঝেনা। যেনো ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেনা। আদনান কড়া দৃষ্টিতে একবার চারপাশে তাকালো। কোনো শব্দ ছাড়াই চেয়ার টেনে বসে গেলো।
আদনানের পছন্দ নয় অতিরিক্ত শব্দ। চামচ-ছুরির টুংটাং শব্দও যেন কানে বিঁধে যায়। রিতু এসে তার সামনে এক কাপ গরম গ্রীন টি রাখলো। কাঁচের টেবিলে কাপ রাখতেই হালকা টুং শব্দ হলো। সাথে সাথে আদনান চোখ বন্ধ করে ফেললো বিরক্তিতে। তারপর আগুন ঝরা চোখে তাকালো রিতুর দিকে। রিতু ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে দ্রুত বলে উঠলো,
“ভুল হয়ে গেছে ভাইজান, আর হইবো না।”
বলেই ছুটে গেলো রান্নাঘরের দিকে। ডাইনিং টেবিলে আবার নীরবতা নেমে এলো। কেবল থালা-বাসনের নরম শব্দ। আদিল আর আহিয়া একে অপরের দিকে তাকালো। চোখের ইশারায় দুজন হালকা হেসে নিলো আদনানকে নিয়ে। কিন্তু সেই হাসিও যেন নিঃশব্দে, কারণ তারা জানে আদনানের সামনে বেশি বাড়াবাড়ি মানেই বিপদ।
হঠাৎ সিঁড়িতে ধপধপ পায়ের শব্দ ভেসে এলো। পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে, চুলগুলো এলোমেলো ভঙ্গিতে, আত্মবিশ্বাসী কায়দায় নেমে এলো আহাদ রাজা।ডাইনিংয়ের পাশে এসে দাঁড়াতেই সে একবার চারপাশে তাকালো। চোখে দুষ্টু ঝিলিক, ঠোঁটে বাঁকা হাসি। আদনানের দিকে এক ঝটকা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
“গুড মর্নিং এভরিওয়ান!”more....
আমজাদ মীর গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলেন, “গুড মর্নিং।”
আহাদ রাজা তার নির্দিষ্ট চেয়ার টেনে বসল। চেয়ারটা এমনভাবে শব্দ করে টানলো, যেন ইচ্ছে করেই কারো বিরক্তি বাড়ানো তার উদ্দেশ্য। চেয়ার টানার ঘর্ঘর শব্দে আদনান সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললো। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো টেবিলের নিচে, কিন্তু সে নিজেকে সংযত করলো। আহাদ হেসে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সেই দিকে, তারপর চোখ সরিয়ে আহিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আহি, ফ্রুটের ট্রেটা দে তো!”
“আরে ব্রেড টা দে! … না না, এটা নেবো না। চাচি আম্মা, আমার কফি দাও।”
একটার পর একটা চাহিদা, একটার পর একটা শব্দ।
কখনো প্লেট টেবিলে ধপ করে রাখে, কখনো আবার গ্লাস তোলে, আবার টকাস শব্দে নামায়। আদনান ভালো করেই জানে, আহাদ ইচ্ছে করেই এসব করছে। কারণ এই বাড়িতে একমাত্র মানুষ, যার সাথে আদনান কখনোই পেরে ওঠে না, সে হলো আহাদ রাজা। বয়সে তার থেকে ছয় মাসের ছোট হলেও তার কর্ম কান্ড ছোট না। আমজাদ মীর ছেলের কান্ড দেখে মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আসফাক মীর মুখ টিপে হালকা হাসলেন, এই দুই ভাইয়ের অঘোষিত শত্রুতা পুরো বাড়িই বোঝে। নাস্তা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন আমজাদ মীর। আহাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি যাচ্ছি। তুমি কিন্তু সময়মতো চলে আসবে। নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি, সংসদে আজ জরুরি সভা আছে। তোমার বক্তব্য রাখতে হবে।”
“না বাবা, এত গুরুত্বপূর্ন বিষয় আমি কি করে ভুলতে পারি।”
আহাদ চেয়ার ঠেলে একটু গা এলিয়ে দিয়েই বললো কথাটা। কথাটা বলার সময় তার চোখ ছিল সরাসরি আদনানের দিকে। কেমন যেন চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আমজাদ মীর আর আসফাক মীর বেরিয়ে গেলেন। এই ফাঁকে আদিবা চুপচাপ উঠে আদনানের কাছে এলো। নয় বছরের কচি মুখ, কিন্তু চোখে বুদ্ধির ঝিলিক।more....
“ভাইয়া, আমার হোমওয়ার্কে তোমার সাহায্য লাগবে। চিকিৎসা বিষয় নিয়ে লিখতে হবে।”
আদনান হালকা হাসলো। তার ছোট্ট বোনের মাথায় স্নেহভরে হাত রাখলো।
“ওকে, আমি করে দেব।”
এই বাড়িতে আদনানের সবচেয়ে প্রিয় হলো আদিবা। কারণ সে অন্যদের মতো বেহুদা হৈচৈ করে না। সবকিছু গুছিয়ে করে, মনোযোগ দিয়ে চলে। আসলে বয়সে ছোট হলেও বুদ্ধিতে সে আহিয়া-আদিলকে হার মানায়। আদিল তখন বাহিরে যাবার জন্য প্রস্তুত। হাত ধরে আদিবাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো দুজনেই। আদনানও উঠে দাঁড়ালো। ঠিক সেই সময় রান্নাঘর থেকে এগিয়ে এলেন হালিমা বেগম,
“আদনান বাবা, আজ চেষ্টা করো একটু আগে আসতে। আপা তোমার সাথে জরুরি কথা বলবে। হয়তো কোথাও যেতে হবে।”
“আমি চেষ্টা করবো, চাচি আম্মা।”
বলেই দরজার দিকে এগোতে শুরু করলো। ঠিক তখনই আহিয়া ফিসফিস করে হালিমা বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,
“চাচি আম্মা, আজকেও কি আদনান ভাইকে আম্মু পাত্রী দেখাতে নিয়ে যাবে?”
কথাটা শুনেই আদনানের পা থেমে গেলো দরজার কাছে। মুহূর্তেই কান খাড়া হয়ে গেলো তার। সে নীরবে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলো তাদের কথোপকথন। হালিমা বেগম ধীরে উত্তর দিলেন,
“মনে হয় তাই। তবে আপা তো এখনো কিছু স্পষ্ট বলেনি।”
“আরেহ..! আর কত মেয়ে দেখবে? দুই মাস ধরে প্রতি সপ্তাহেই একটা করে মেয়ে দেখে। তবুও কোন মেয়ে পছন্দ হয় না।”
“এটা বিয়ে আহি। ছেলে খেলা না। জীবনসঙ্গী বেছে নিতে সময় তো লাগবেই। মনের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া সহজ না।”
এতক্ষণ চুপচাপ খাবার খেতে খেতে সব শুনছিলো আহাদ।
এবার সে এক গ্লাস পানি খেলো। অতঃপর টকাস শব্দ করে গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো। চোখে বিদ্রূপের ঝিলিক, ঠোঁটে কটাক্ষ ভরা হাসি,
“কে মেয়ে দিবে ওরে? ওর মতো শুচিবায়ু-র কপালে, ভেটকি মাছের মত মেয়েও জুটবে না।”
কথাটা যেন তীরের মতো গিয়ে বিঁধলো আদনানের কানে।
মুহূর্তেই তার শরীর শক্ত হয়ে গেলো। কোন উত্তর না দিয়ে, গম্ভীর মুখে গটগট করে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। আহাদ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের এক হাসি টেনে দিলো, একটা জয়ী ভঙ্গির হাসি।
★
সকাল থেকেই সংসদ ভবনের চত্বর মুখরিত। গেটে প্রবেশ করছে একে একে কালো গাড়ি। টাইট নিরাপত্তা, চারপাশে মিডিয়ার ভিড়। সবাই যেন অপেক্ষায় আজকের গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনের জন্য। কারণ আর মাত্র কয়েক মাস পরেই জাতীয় নির্বাচন। কে ক্ষমতায় থাকবে, কারা ছিটকে পড়বে। সব হিসাব-নিকাশ নির্ভর করছে এই সময়কার সিদ্ধান্তের উপর। সংসদ ভবনের ভেতরে জমায়েত হয়েছেন দেশের প্রভাবশালী মন্ত্রী, সাংসদ, শীর্ষ নেতারা। প্রতিটি মুখে টানটান গম্ভীরতা, আবার কারো কারো চোখেমুখে আগাম প্রচারণার উত্তেজনা। সভাপতি মঞ্চে বসে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। প্রথমেই অর্থমন্ত্রী বাজেট সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন।
“নির্বাচনের আগে জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখতে দরকার স্থিতিশীল বাজার, ভর্তুকি বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি।”
প্রতি বক্তৃতায় অন্যরা মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলো। এরপর বক্তব্য দিলো কৃষিমন্ত্রী, তারপর বিদেশেমন্ত্রী। কিন্তু সব কিছু যেনো প্রচলিত, গৎবাঁধা কেউ নতুন কিছু বলছে না।
সবাই যখন কিছুটা নিরুত্তাপভাবে শুনছে, তখনি ধীরে ধীরে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো আহাদ রাজা মীর। তরুণ বয়স হলেও তার ভঙ্গি, দৃষ্টি, তীক্ষ্ণতা সবার দৃষ্টি কাড়তে যথেষ্ট। কালো চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলো। পান্জাবির হাতা গুটিয়ে নিলো এক ভঙ্গিতে। তারপর হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নাক ঘষে নিলো, যেনো নিজেকে যুদ্ধের ময়দানে প্রস্তুত করছে। আহাদ রাজা গম্ভীর অথচ কণ্ঠে দৃঢ়তার সুরে বলতে শুরু করলো।
“আমরা সবাই জানি নির্বাচন আমাদের সামনে। কিন্তু আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, নির্বাচন শুধু ক্ষমতায় আসা যাওয়ার খেলা না। এটা হচ্ছে জনগণের বিশ্বাসের পরীক্ষা।” more....
কিছুক্ষণ থেমে সবার চোখে চোখ রেখে আবার বক্তব্য রাখলো। কিছু সাংসদ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। কেউ কেউ চশমা খুলে খাতায় নোট নিতে শুরু করলো। আহাদ রাজা এবার টেবিলে হালকা চাপড় মেরে শেষ বক্তব্য রাখলেন,
“আজকের প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি সক্রিয়। তারা কথা শুনতে চায়, প্রশ্ন করে, সমালোচনা করে। আমরা যদি তাদের প্রশ্ন এড়িয়ে যাই, তাহলে তারা অন্য বিকল্প বেছে নেবে। আমরা চাই তরুণদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তাদের আস্থা অর্জন।”
কথা শেষ হতেই সভাকক্ষে করতালি বেজে উঠলো। কারো মুখে অবাক বিস্ময়, কারো চোখে প্রশংসা। কিছু বয়সে প্রবীণ নেতারাও সায় দিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আহাদ রাজা মাথা নেড়ে সবার প্রতি সম্মান জানালো, চশমাটা আবার পরে নিয়ে চেয়ার ঠেলে আসনে বসলো এক গর্বিত অথচ শান্ত ভঙ্গিতে।
★
গরম দুপুর, ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। ক্যাম্পাসের মাঝখানে পুরোনো বটগাছটার নিচে রাখা লাল নীল ছাতার শেড,
সেখানে বসে আছে রিদিতা আর আনিকা। আনিকা সব বান্ধবিদের তুলনা লম্বায় একটু বেশি, গায়ের রং চাপা হলেও মুখের গঠন সুন্দর, আর তার হাসিটা বেশি সুন্দর, তার দুই পাশের দাঁত দুটো বাঁকা হওয়াতে আরও বেশি ঝিলিক ছড়িয়ে পরে হাসিতে।
তবে তার একটাই দুঃখ এই বয়সেও একটা জামাই নাই!
অন্তত একটা বয়ফ্রেন্ড থাকা উচিত ছিলো। প্রতিদিনই এ নিয়ে তার একই কান্নাকাটি, আর সেই দুঃখ শোনার দায়িত্ব পড়ে রিদিতার উপর। রিদি বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে বলে,
“দোস্ত, তুই বরং একটা পোস্টার ছাপাইস ‘বয়ফ্রেন্ড চাই, জরুরি ভিত্তিতে দরকার।’”
তার কথা শুনে আনিকা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। এমন সময় এসে যোগ দিলো আহিয়া আর নীলা।
চার জন মিলে গল্প জমে উঠলো। কিছুক্ষণ আড্ডার পর নীলা বললো,
“দোস্ত, চল না ক্যান্টিনে যাই, আমার খুধা লাগছে!”
আনিকা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো,
“চল যাই ! সিঙ্গারা খেয়ে আসি।”
কথাটা বলেই রিদির হাত ধরে টান দিলো। রিদি হালকা খিঁচে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“আহহহ! ছাড়, ছাড়… ব্যাথা করছে।”
“কিরে, কি হইলো?”
“এখানে কেটেছিলো, ব্যাথা।”
“ওহহ, আচ্ছা, চল এখন।”
“না, আমি যাবো না। আমার পা ব্যাথা করছে।”
আহিয়া ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো,
“আরে সমস্যা কি তোর, চল তো!”
“না ভাল্লাগছে না, এত দূর হেটে যেতে ইচ্ছা করে না, আমার পা ব্যাথা করে।”
নীলা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
“তোর আবার কই ব্যাথা না করে বল? কখনো মাথা, কখনো হাত, কখনো পা…”
আনিকা হেসে বললো,
“দোস্ত, ওরে দেইখা আমারে একটা গান মনে পড়ছে। ওই যে ওই টা, তোর কোন কোন জায়গায় ব্যাথা গো বান্ধবী ললিতা…”
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। নীলা চোখ পাকিয়ে বললো, “ললিতা না, রিদিতা!”
“ওহ তাই তো!”
তারপর তিনজন একসাথে দু আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজিয়ে গেয়ে উঠলো,
“তোর কোন কোন জায়গায় ব্যাথা গো বান্ধবী রিদিতা…
ও তোর কোন কোন জায়গায় ব্যাথা গো বান্ধবী রিদিতা…”
রিদির চোখ লাল হয়ে গেলো রাগে। কটমট করে তাকলো ওদের দিকে, মনে হলো এখনই ওদের কাঁচা চিবিয়ে ফেলবে। কিন্তু রিদিতাকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, তিনজন থামার বদলে আবার অন্য সুর ধরলো,
“এই চায়া রইছোস ক্যান কি কবি ক… তুই কইলেই তো আমরা কমু হ…”
বলেই হো হো করে হেসে উঠে দৌড় দিলো। রিদি এবার আর সহ্য করতে পারলো না। পায়ের জুতা খুলে হাতে নিয়ে দৌড়ে গেলো তাদের দিকে। তিনজন ফসফস করে ছুটলো আনিকা হাসতে হাসতে পেছনে তাকিয়ে চেঁচালো,
“ভাগ লাল, ভাগ!”
আহিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে নিশ্বাস ফেলে বললো,
“আরে লাল না, ওর নাম তো নীলা! নীল বল!”
আনিকা আবার সংষোধন করে বললো, “ভাগ নীল ভাগ!”
এই নিয়ে সবাই আরও জোড়ে হেসে উঠলো। গেটের কাছাকাছি এসে রিদি দাঁতে দাঁত চেপে হাতের জুতাটা নিশানা করে ছুড়ে মারলো ওদের দিকে। তারা তিন জন মাথা নিচু করে নিজেদের বাঁচলো। কিন্তু সেটা গিয়ে সোজা আঘাত করলো একটা কালো ঝকঝকে গাড়ির কাঁচে। চপচপ শব্দে সবার চোখ সেই গাড়ির দিকে গেলো। এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর ধীরে ধীরে নামলো গাড়ির জানালা। ভেতরে বসে আছে আহাদ রাজা মীর। গাঢ়ো বাদামি চোখ দুটোতে যেনো আগুন জ্বলছে। দৃষ্টি এতটাই তীক্ষ্ণ যে, মনে হলো রিদির বুকের ভেতর ঘায়েল করে দিচ্ছে। রিদিতা কেঁপে উঠলো। ভয়ে আঙুল কামড়ে ধরলো। বিপদ থেকে বাঁচার দোয়া পড়তে গেলো, কিন্তু ভয়ে সব দোয়া দুরুদ ভুলে গেলো। তাই মনে যা আসলো তাই পড়তে শুরু করলো,
“আল্লাহু আকবর… লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ… আলিফ, বা, তা, ছা… যিম, হা, খা… দ্বাল, ঝাল, র, ঝ.. ছীন, শ্বীন.. আল্লাহ এবারের মতো আমারে বাঁচিয়ে দিন। more....
কালো গাড়ির দরজা খুলতেই বের হয়ে এলো আহাদ রাজা মীর। সাদা পাঞ্জাবির হাতা গুটানো, বুকের ওপর হালকা ঘামে ভিজে থাকা দাগ, চোখদুটো যেন আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার তিন পান্ডা শাহীন, নাদিম আর শাওন। আর একটু পেছনে গম্ভীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে গার্ডরা। ক্যাম্পাসের বাতাস এক মুহূর্তে থমকে গেলো। সবার হাসি-ঠাট্টা, আড্ডা সব থেমে গিয়ে নীরবতা নেমে এলো চারপাশে।
কয়েক ঘণ্টা আগেই সংসদ ভবনের জরুরি সভা শেষ করেছে সে। কিন্তু সভা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ মনে পড়লো রিদিতার হাতের কা'টা দাগটা, সেটা পুরোপুরি সেরে উঠেছে কি না জানতে ইচ্ছে করলো। দু'বার ফোন করেছে, তবে রিসিভ হলো না। আর আহাদ রাজা সব কিছুতে দু'বার অপশন দেয়, তৃতীয়বারে এ্যাকশন নেয়।
এবারও ব্যতিক্রম হলো না। সরাসরি গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলো ভার্সিটিতে। ভেবেছিলো শান্তভাবেই জিজ্ঞেস করবে,
তার ফোন তোলে নাই কেন, তবে আসার সাথে সাথেই তার প্রেয়সী তাকে এভাবে ওয়েলকাম করবে সেটা সে ভাবেনি। আহাদ রাজা গম্ভীর দৃষ্টিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি সরাসরি রিদিতার বুক ভেদ করে যাচ্ছে। আনিকা, নীলা আর আহিয়া ভয়ে এক কোণে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের মুখের হাসি উধাও, মনে হচ্ছে কেউ তাদের শ্বাস রুদ্ধ করে রেখেছে।
রিদিতার বুক ধড়ফড় করছে। প্রতিটা ধ্বনি যেনো গুনে গুনে শোনা যাচ্ছে। এখনই মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ড ফেটে বের হয়ে আসবে, না হলে সোজা অজ্ঞান হয়ে যাবে। চোখের সামনে সবকিছু ঘুরছে। এক মুহূর্তে মনে হলো সামনে দুইজন আহাদ রাজা দাঁড়িয়ে আছে, না.. না এবার তিনজন হয়ে গেলো!
No comments: