হাতিরঝিলের লেকের পাড়ে। রাত তখন প্রায় একটা।
পানি নিস্তব্ধ, শুধু মাঝে মাঝে দূরের বাতাসে দুলছে পানকৌড়ির ডাক। আহাদ রাজা শুয়ে আছে নিজের কালো গাড়ির বনেটে। এক হাতে সি'গারে'টের ধোঁয়া উড়ছে, অন্য হাতে অ্যা'ল'কো'হ'লে'র বোতল। এটা তার পুরোনো অভ্যেস, যখন ভেতরটা খুব ভারী লাগে, যখন কোনো উত্তর খুঁজে পায় না, অথবা যখন একান্ত সময় দরকার হয়। তখন এখানে এসে গাড়ির বনেটে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো ধোঁয়া ছাড়ে, কখনো ছোট ছোট চুমুক নেয় বোতল থেকে।
তবে আজকের রাত অন্যরকম। আজ সে সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছে। যতটা কখনো খায়নি, আজ তার চেয়েও বেশি ড্রিংক করেছে। কারণ একটাই, রিদিকে খুঁজে না পাওয়া।
নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে তার কাছে। যে মেয়েকে কখনো সরাসরি দেখেনি, যাকে স্পর্শ করেনি, যার কণ্ঠ
শোনেনি, শুধু এক ঝলক পরিচয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে সবকিছু। তার জন্যই ভেতরটা কেমন ছটফট করছে।
এক চুমুক দিলো বোতল থেকে, তারপর চোখ তুলে তাকালো আকাশের দিকে। অসীম কালো আকাশে এক ঝলক উজ্জ্বল তারা জ্বলছে। সেই তারার দিকে আঙুল তুললো আহাদ রাজা, অতঃপর আধো মাতাল কণ্ঠে গুনগুন করে গেয়ে উঠলো,
“পড়ছে কেন বিনা মেঘেই বাজ
পদ্য লেখা আমার তো নয় কাজ,
চাইছি দিনে অল্প দেখা তোর
পাল্টে দিতে আমার গল্পের মোড়,
কিছুতেই উপায় মেলে না....
ও... মন বোঝে না, বোঝে না, বোঝে না
মন বোঝে না, বোঝে না...”more...
কণ্ঠ ভাঙা, কিন্তু ভেতরে অদ্ভুত তীব্রতা। যেন সুর নয়, বুক ফেটে যাওয়া আর্তনাদ।
রাত প্রায় একটা পঁইতাল্লিশ। গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির গেট পার হয়ে ঢুকলো। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ, সব লাইট নিভে গেছে, শুধু লাইব্রেরি কর্নারের হলদে আলো টিমটিম করছে। আহাদ বাড়ির ভেতরে ঢুকেই সোজা গেলো সেদিকে। সেখানে বসে আছেন তার বাবা "আমজাদ মীর"। ডেস্ক ভর্তি ফাইল, চোখে পুরু চশমা, মন দিয়ে নথি পড়ছিলেন তিনি। আহাদ কিছু না বলেই ধপ করে সোফায় গা এলিয়ে বুুঁদ হয়ে শুয়ে পরলো। ভারি নিশ্বাস ফেললো। আমজাদ মীর চোখ নামিয়ে তাকালেন ছেলের দিকে। অতঃপর পর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“আবার কার পিছু নিয়েছো? কোনো নতুন ঝামেলায় জড়িয়েছো?”
আহাদ হালকা মাতাল কণ্ঠে মুচকি হেসে বললো,
“তোমার বৌমার পিছু… কিন্তু আল্লাহর বান্দি, মাগুর মাছের মতো বারবার হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ধরতেই পারছি না।”
আমজাদ মীর চমকে উঠলেন। যে ছেলে রাজনীতি ছাড়া মুখ খোলে না, সে আজ নারীর কথা বলছে?
তিনি চশমা নামিয়ে গভীরভাবে তাকালেন ছেলের দিকে।
“ভবিষ্যৎ মন্ত্রী যদি সামান্য এক নারীর জন্য এভাবে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে, তাহলে দেশ সামলাবে কিভাবে?”more...
আহাদ হেসে ফেললো। হাত উঁচু করে আঙুল নাড়লো।
“উঁহু… ও সামান্য না। ও অসামান্য… মারাত্মক।”
আমজাদ মীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“তুমি নেশার ঘোরে বলছো নাকি সত্যিই কোনো নারীর আগমন ঘটেছে তোমার জীবনে?”
আহাদ আবার হাত উঁচু করে দৃঢ় স্বরে বললো,
“হান্ড্রেড পারসেন্ট সত্যি।”
“তাহলে এখন আমার কাছে কী চাও তুমি?”
আহাদের কণ্ঠ গম্ভীর হলো।
“খুঁজে দাও তাকে।”
আমজাদ মীর চেয়ারে হেলান দিলেন।
“ঠিক আছে। কাল সকালে নেশা কাটলে ডিটেলস দিও।
লোক লাগিয়ে এনে দেবো।”
কিন্তু হঠাৎই উঠে দাঁড়ালো আহাদ। চোখে প্রচণ্ড আগুন।
আঙুল তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“নোপ! কোন দরকার নেই, আমি নিজেই খুঁজে বের করবো আমার প্রেয়সীকে।”
বলে পাশের চেয়ার থেকে জ্যাকেটটা তুলে নিলো। চলতে শুরু করলো সিঁড়ির দিকে। আমজাদ মীর মৃদু হেসে পেছন থেকে বললেন,
“গুড নাইট।”
আহাদ হাঁটতে হাঁটতে পিছন ফিরে হাত নাড়লো,
“হুমম… গু..ড নাইট…”
অতঃপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে নিজের রুমে ঢুকলো।
ধপ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো।
★
হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশন!
টেবিলের ওপরে রাখা ফোনটা কেঁপে কেঁপে আওয়াজ তুলছে। ভ্রু কুঁচকে যায় আহাদের। ঘুমন্ত হাত বাড়িয়ে ফোন খুঁজে বের করে, চোখ না খুলেই চাপ দিয়ে বন্ধ করে দিলো।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা…
তারপর আবারও শুরু হলো ফোনের ভাইব্রেশন। এবার রেগে গেলো আহাদ। কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
“বা’লের মোবাইল, শান্তিতে ঘুমাতেও দেয় না।”
রাগের মাথায় রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো শাহীনের কণ্ঠ,
“ভাই… আর কত ঘুমাবেন? বারোটা বাজতে গেছে।”
আহাদ আধো ঘুমের গলা টেনে বললো,
“সো হোয়াট? আজ দুইটা পর্যন্ত ঘুমাব। ডিস্টার্ব করবি না।
না হলে কি করব জানিস তো!”
শাহীন চুপ করে এক সেকেন্ড, অতঃপর হালকা ব্যঙ্গ মিশিয়ে বললো,
“ভাই… সময় বারোটা না, আপনার বারোটা বাজতে গেছে।”
আহাদ চোখ কুঁচকে গেলো।
“মানে?”
“মানে… আপনার সেই প্রেয়সীর কলেজ টাইম শেষ হয়ে গেলো বলে। এখন না গেলে আবার হাত ফসকে যাবে।”
“প্রেয়সী” শব্দটা শুনতেই আহাদের ঘুম ভেঙে গেলো একদম। ফট করে চোখ বড় বড় করে তাকালো। পাশের টেবিলে রাখা ঘড়ির দিকে চোখ গেলো, সময় প্রায় বারোটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই!
“ভাই, সকাল নয়টা থেকে কল করতেছি। আপনি বার বার কল কেটে দিচ্ছিলেন।”
আহাদ আর কিছু না বলে রাগে আবার ফোন কেটে দিলো।
তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই, ধপ!
আবার বিছানায় লুটিয়ে পড়লো। চোখ পড়লো নিজের শরীরে… সেই লাল শাড়িটা তার গায় পেচানো! মুহূর্তেই থমকে গেলো। অতঃপর হালকা মুচকি হাসলো নিজের অজান্তেই।
“এভাবে শাড়িতে পেঁচিয়ে রাত কাটালাম! অদ্ভুত বটে…”
কিন্তু সময় তো আর থেমে নেই। সে তাড়াতাড়ি উঠে শাড়িটা গুছিয়ে রাখতে গেলো আলমারিতে। কিন্তু শাড়ি লম্বায় যেনো অন্তহীন। কয়েকবার চেষ্টা করেও ভাঁজ করতে পারলো না। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে সেটাকে একটা গোল বলের মতো গুটিয়ে আলমারির ভেতরে ঠুসে দিলো।
“যা হোক! পরে সামলাবো।”
এরপর বাথরুমে ঢুকে দ্রুত শাওয়ার নিলো। চুল ভিজে কপালে ঝুলছে, তবুও আয়নায় একবার নিজের দিকে তাকিয়ে হেসে নিলো। পকেটে ওয়ালেট গুঁজে গর্জন করে বললো,
“জা..নু, এবার আপনাকে যদি পাই, থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো।”
দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে, ইঞ্জিন স্টার্টের গর্জন উঠলো, চাকা ঘুরতেই ধুলো উড়লো চারপাশে।
ক্লাস শেষ করে ডিপার্টমেন্টের সামনে একটা টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো চারজন মেয়ে, আহিয়া, নীলা, আনিকা আর মিতু। ক্যাম্পাসের বাতাসে হাসি-ঠাট্টার শব্দ ভেসে আসছে, হালকা বাতাস বইছে বটগাছের নিচে। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো টায়ারের চিৎকার।
চিৎ ~ ইইইইইইক!
একসাথে থামলো কয়েকটা কালো গাড়ি।
সবাই অবাক! পুরো ক্যাম্পাসের চোখ ঘুরে গেলো সেদিকে। দেখা গেলো কালো গাড়ির দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে নামছে একদল মানুষ। সবার সামনে হাঁটছে সেই নামটা, যে নাম শুনলেই র'ক্ত হিম হয়ে আসে, আহাদ রাজা মীর!
তার পিছনে শাহীন, নাদিম, শাওন, আর চারপাশে লম্বা চওড়া গার্ডদের সারি। এই খবর মুহূর্তেই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো পুরো ভার্সিটিতে, “আহাদ রাজা মীর কলেজে এসেছে!”
ভিড় জমলো করিডোর, বারান্দা, জানালায়। সবাই তাকিয়ে আছে, মোবাইল বের করে ভিডিও করছে অনেকে। আহাদের চোখ তীক্ষ্ণ, পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সরাসরি সেই টেবিলের দিকে যেখানে বসেছিলো আহিয়া। আহিয়া টেবিল থেকে নেমে চুপচাপ ঘুরে চলে যেতে চাইলো।
মুখ ভার, কারণ সে চায় না, কেউ বুঝুক যে আহাদ তার ভাই। যতবার মানুষ জানে, ততবার ভয়ে দূরে সরে যায় তার কাছ থেকে। কিন্তু আহাদের চোখ এড়ানো সহজ নয়। গভীর গলায় ডাক দিলো,
“ওই আহি! কই যাস? এইদিকে আয়।” more...
আহিয়া দাঁড়িয়ে গেলো। চোখে বিরক্তির ছাঁপ। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ভাইয়ের দিকে। তার পিছনে কৌতূহলী হয়ে দাঁড়ালো নীলা, আনিকা আর মিতু। আহাদ দুই আঙুল দিয়ে নাক ঘষলো, একটা ভঙ্গি তার অভ্যাসের মতো।
“কী রে? আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছিলি কেনো?”
“কোথায় পালিয়ে যাচ্ছিলাম।”
আহাদ এবার চোখ ঘুরালো আহিয়ার বান্ধবীদের দিকে।
মুখে হালকা হাসি টেনে বললো,
“তোর বান্ধবীদের সাথে পরিচয় করাবি না? তোর ভাই এসেছে।”
আহিয়া অনিচ্ছুকভাবে বললো, “নীলাকে তো চেনোই।”
নীলা মুচকি হেসে হাত নাড়লো, “হাই আহাদ ভাই।”
আহাদ শুধু চোখের ইশারায় জবাব দিলো। তারপর তাকালো বাকিদের দিকে। আহিয়া বললো,
“এটা আনিকা, আর ও মিতু।”
আনিকা আর মিতু ভদ্রভাবে সালাম দিলো। আহাদ সালাম নেওয়ার ভঙ্গি করলো না, বরং ঠাণ্ডা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“আরেকজন কই?”
আহিয়া অবাক হয়ে বললো,
“ওহহ… রিদি? রিদি তো একটু আগে চলে গেছে।”
আহাদের চোখ লাল হয়ে উঠলো। চেঁচিয়ে উঠলো,
“চলে গেছে মানে! কই গেছে?”
পুরো ডিপার্টমেন্ট থমকে গেলো। শত শত চোখ তাকিয়ে রইলো এ দৃশ্যে। আহিয়া গলা নামিয়ে শান্তভাবে বললো,
“ওর নাকি কিছু কাজ আছে। কোনো সার্ভিসিং দোকান থেকে ফোন নেবে, তারপর নাকি হাসপাতালে যাবে।
আরও কী কী বললো…”
আহাদ হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালো শাহীনের দিকে। চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর।
“আবার হসপিটাল!? শাহীনের বাচ্চা.!!
আমি কি লাটিম? কাল থেকে শুধু লাটিমের মত ঘুরছি, আর তোরা সব কটা কি করছিলি? কলেজের সামনে ঘোড়ার ঘাস কাটছিলি?”
তার হুংকারে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে গেলো।
শাহীন হকচকিয়ে গেলো, নাদিম আর শাওন দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ালো, শাহীনকে সামনে রেখে দিলো সিংহের সামনে হরিণের মতো। আহাদ দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“আমার মন চাইতেছে এখন…”
শাহীন গলা কাঁপিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি চায় ভাই… আপনার মন?”
আহাদ হঠাৎ ঠোঁটে হালকা হাসি ফোটালো। শাহীনের ঘাড়ে হাত রেখে বললো,
“আইসক্রিম খেতে মন চাইতেছে। চল, আইসক্রিম খেয়ে আসি।”
সবার মুখে বিস্ময়! চারপাশে চাপা হাসি ছড়িয়ে গেলো।
পিছন থেকে হঠাৎ আহিয়ার কণ্ঠ ভেসে এলো, “ভাইয়া, আমাদেরও নিয়ে যাও।”
আহাদ একটু ঘাড় বাঁকিয়ে বোনের দিকে তাকালো,
তারপর দম্ভভরা ভঙ্গিতে ঘোষণা দিলো,more...
“চল, সবাইকে খাওয়াবো। আহাদ রাজা মীরের পক্ষ থেকে আজ সবার জন্য ফ্রি! ফ্রি! ফ্রি!”
পুরো ক্যাম্পাসে যেনো এক মুহূর্তের জন্য বজ্রপাত হলো।
কিন্তু আহাদের দলের লোকেরা, যারা ভেতরে ভেতরে কাঁপছে, তারা বোঝে ভাই হঠাৎ খুশি হলে তার পেছনে লুকিয়ে থাকে আরও বড় ঝড়ের আগমন।
ভার্সিটির গেট পেরিয়ে রাস্তার অপর পাশে এক বিশাল আইসক্রিম পার্লার। সেখানে ভেতরেই এক কোণে বসেছে আহিয়া, নীলা, আনিকা আর মিতু। সবার হাতে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কাপে আইসক্রিম। হালকা রোদে ঝলমল করছে সেই কাপের রঙিন স্কুপগুলো। আহিয়া ধীরেসুস্থে খাচ্ছে, নীলা কিছুটা চুপচাপ। কিন্তু আনিকা আর মিতু চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে অন্য টেবিলের দিকে। যেখানে বসে আছে, আহাদ রাজা মীর। অন্য সবার মতো সাধারণভাবে নয়, বরং উঠে বসেছে পুরো টেবিলের উপর। খুব মনযোগ দিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে এখন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন, শাহীন, নাদিম আর শাওন।
তারা দাঁড়িয়ে আছে, ঠকঠক করে কাঁপছে। কারণ তাদের শাস্তি হিসেবে বিশাল বিশাল বরফের খণ্ডের উপর খালি পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। হাতে ধরা ঠাণ্ডা আইসক্রিম। পাশে দাঁড়িয়ে আছে গার্ডরা, সবাই চুপ চাপ কারণ সবাই জানে, এটা ভাইয়ের খেলা নয়, শাস্তি। আহাদ মাথা উঁচু করে তাকালো তাদের দিকে। ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি ফুটলো।
“কি হলো? খাচ্ছিস না কেনো? খা… যতক্ষণ না এই বরফ গলবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত আইসক্রিম খেতেই হবে।”
শাহীন, নাদিম আর শাওনের ঠোঁট নীল হয়ে যাচ্ছে ঠাণ্ডায়।
কিন্তু কিছু বলার সাহস নেই কারো। বরফ গলছে ধীরে ধীরে, তাদের শরীরের কাঁপুনি ততই বাড়ছে। আনিকা ভয়ে ফিসফিস করে বললো,more...
“এই আহিয়া… তোর ভাই এতো নির্দয় কেনো? কোন মায়াদয়া নেই নাকি?”
“এটা তো শুধু ট্রেইলার। এর চেয়েও ভয়ংকর শাস্তি পেয়েছে ওরা বহুবার।”
আনিকা আর মিতু একে অপরের দিকে তাকালো। চোখে ভয়, অবিশ্বাস। তারা জানতো আহাদ রাজার নাম, তার দাপটের গল্প, কিন্তু এতটা নির্মমতা সামনে থেকে প্রথম দেখলো। নীলা কিন্তু চুপ। সে অনেক কিছু জানে,
আহাদের ভেতরের অন্ধকার দিকগুলোর সাথে পরিচিত।
আর এদিকে আহাদ কোনো কিছুর পরোয়া না করে, আস্তে আস্তে নিজের আইসক্রিম খেয়ে যাচ্ছে। তার ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠছে রহস্যময় হাসি। সবার মনে তখন একটাই প্রশ্ন, এ কি শুধু খেলা, নাকি ঝড় আসছে আরও বড়?
পরেরদিন সকালবেলা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তড়িঘড়ি করে ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে ফেললো রিদিতা। আজ তার পরনে নেভি ব্লু আর ব্ল্যাক কম্বিনেশনের কুর্তি-পায়জামা।
ঠোঁটে হালকা লিপ-গ্লস চোখে কোনো সাজসজ্জা নেই।
তবু তার ভেতরে অদ্ভুত এক দীপ্তি, ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে জুতা পরতে পরতে বলে,
“বুবু..! আমি গেলাম কিন্তুু।”
ঈশানী রুম থেকে বের হয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
“কই যাস না খেয়ে? টেবিলে সব রাখা আছে, খেয়ে যা।”
“খাবো না। এখন ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া অলরেডি নয়টা বাজে। সময় নেই।”
ঈশানী রেগে গেলো মূহুর্তেই, চেঁচিয়ে বলল,
“দেয়ালের সাথে একটা টাক দিবো তোরে আমি! ঠিকমতো খায় না দায় না। মাসের এিশ দিনের মধ্যে পনেরো দিন বেহুঁশ হয়ে যেখানে সেখানে পরে থাকছ। আব্বুকে বলে দেবো, তোরে যেনো নিয়ে যায়। আমার কাছে থাকা লাগবে না।”
কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই রিদিতা চুপচাপ দরজা ঠেলে বের হয়ে গেলো। ঈশানী রেগে ডাকলো,
“রিদি…!!”more...
ডিপার্টমেন্টের করিডোর ধরে হাঁটছে রিদিতা আর আনিকা।
দু’জনের বন্ধুত্ব অন্যদের চেয়ে আলাদা, তারা দুজন একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ। কারণ দু’জনেই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। আনিকার বাবা নেভি অফিসার, ছোট পরিবার, এক ভাই, এক বোন। আর রিদিতার পরিবার বড়, চার ভাইবোন। বড় ভাই ইব্রাহিম, তারপর ঈশানী, এরপর সে নিজে, আর সবার ছোট বোন রাফিয়া। তার বাবা একজন শিক্ষক আর মা গৃহিণী। তার পুরো পরিবার গ্রামে থাকে আর সে তার বোনের কাছে থেকে পড়াশুনা করে।
আহিয়া আর নীলার সাথে তাদের বন্ধুত্ব আছে, তবে
উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের অদৃশ্য দেয়ালটা সবসময়ই অনুভূত হয়। কথা বলতে বলতে তারা পৌঁছালো ক্লাসরুমের কাছে। হঠাৎ তারা খেয়াল করলো দরজার সামনে অদ্ভুত ভিড়। সবার মুখে চাপা গুঞ্জন।
“কিরে, কি হয়েছে? এত ভিড় কেনো?”
মিতুর সাথে দেখা হতেই রিদি জিজ্ঞেস করলো।
মিতু হালকা ফিসফিস করে বললো,
“শুনিস নাই? আজ নাকি নাম ধরে ধরে ক্লাসে ঢুকাচ্ছে।”
রিদি অবাক হয়ে গেলো।
“কেনো? আমরা কি নতুন নাকি? নাম শুনে ঢোকানোর আবার কি আছে?”
আনিকা হালকা বিরক্ত হয়ে বললো,
“হুম, একদম ঠিক বলছিস। এটা আবার কোন নিয়ম, আগে তো কখনো এমন করেনি।”
ধীরে ধীরে ভিড় কমতে লাগলো। তারা এগিয়ে গেলো সামনে। সেই মুহূর্ত রিদিতার চোখ হঠাৎ স্থির হয়ে গেলো। ক্লাসরুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আহাদ রাজা মীর। চেহারায় একধরনের অদ্ভুত শান্তি, কিন্তু সেই শান্তি যেন ঝড়ের আগে গভীর নীরবতা।
মাঝারি উচ্চতা গড়ন। গায়ের রঙ হালকা উজ্জ্বল শ্যামলা। একটা নরম, দীপ্তিময়, উজ্জ্বল মাঝারি টোন। দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার মতো। চোখ ঢাকা কালো চশমায়। চওড়া ঠোঁট, মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গাড়ো চওরা ঘন ভ্রুর ডান দিকে হালকা চাদার মত কাটা দাগ। যা তার রুক্ষ ব্যক্তিত্বকে আরও রহস্যময় করেছে। গায়ে ব্ল্যাক শার্টের উপর ধূসর রঙের ব্লেজার। এক হাত পকেটে, অন্য হাতে মোবাইল, কিছু একটা টাইপ করছে।
রিদির বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। প্রথমবার যেদিন দেখেছিলো, সেদিন সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা ছিলো। গলায় ঝুলানো ছিলো একটা ওড়না। তারপর ফেসবুকে কয়েকবার গোপনে দেখা হয়েছে। কিন্তু আজ, আবার এভাবে সরাসরি তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে, রিদিতা যেন নিজের নিঃশ্বাসই হারিয়ে ফেললো। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো সেই মেসেজের কথা। যদি আজ… সে চিনে ফেলে? যদি বুঝে যায় সবকিছু?
হঠাৎ দু’পা পিছিয়ে এলো রিদি। মনে হলো ঘুরে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু আনিকা হাত টেনে ধরলো।
“কই যাস? ক্লাস করবি না?”
“হ্যাঁ… উমম…”more...
শাহীন নাম ধরে ডেকে ভেতরে ঢোকাচ্ছিলো সবাইকে।
প্রথমে আনিকা নিজের নাম বললো, শান্তভাবে ভেতরে ঢুকে গেলো। এরপর এল রিদিতার পালা।
শাহীন তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নাম?”
গলা শুকিয়ে এলো। তবু রিদিতা বললো, “রিদি… রিদিতা।”
এক মুহূর্তেই ভেতরের বাতাস জমাট বাঁধলো। আহাদ ফট করে চশমা খুলে ফেললো। চোখে আগুন আর অচেনা উন্মাদনা। ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো সেই শব্দ,
“মিস জানু…”
রিদিতা মুহূর্তে চমকে তাকালো। সারা শরীর যেন বরফের ন্যায় জমে গেলো। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে কড়া স্বরে বললো,
“না... আমার নাম রিদিতা রায়ান।”
আহাদ চোখ রাঙিয়ে আবার বললো, “মিস জা…নু।”
রিদি এবার রাগ সামলাতে পারলো না।
“আপনি কি কানে কম শোনেন? আমি বলেছি, রিদিতা।
‘র ই-কার ‘রি’ ‘দ ই-কার ‘দি’ ‘ত আ-কার ‘তা’। রিদি-তা।”
আহাদের রাগ মুহূর্তে চরমে পৌঁছালো। এক ঝটকায় হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরে ফেললো রিদিতার হাত। সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। আহাদ গর্জে উঠলো,
“শাহীন..! দুই মিনিট… জাস্ট দুই মিনিটের মধ্যে এই ক্লাসরুম ফাঁকা চাই। কুইক!”
শাহীন, নাদিম, শাওন, তাদের মুখ সাদা হয়ে গেলো। গার্ডরা সাথে সাথে নড়েচড়ে উঠলো। ছাত্র-ছাত্রী সবাই ভয়ে তাড়াহুড়ো করে বের হতে লাগলো। ক্লাসরুম একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। শুধু দাঁড়িয়ে রইলো আহাদ আর রিদিতা। দুজনের চোখে চোখ, আর চারপাশের বাতাসে অদ্ভুত এক ঘন চাপা উত্তেজনা more...
No comments: