Header Ads Widget

test

#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী (পর্ব) 6

 


#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী 


সন্ধ্যার আলো তখন আস্তে আস্তে গাঢ় হতে শুরু করেছে। আকাশে কমলা-নীল রঙের মিশ্রণে যেন অদ্ভুত রহস্যময়তা ছড়িয়ে আছে। চারপাশে পাখির ডাক, দূরে মাগরিবের আজানের সুর ভেসে আসছে। সেই সময় তাড়াহুড়ো করে রিদিতা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ধপধপ শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে নামছিলো। তার হাতে ফোন। স্ক্রিনে ভেসে আছে ঈশানীর নাম। রিদির মুখে ব্যস্ততা, চোখে অস্থিরতা। মনে মনে বললো,
“আজকে দেরি হলে নিশ্চিত আব্বুরে ফোন দিয়ে সব বলে দেবে।”
শেষ সিঁড়ির ধাপে পা রাখতেই হঠাৎ সামনে থেকে আসা কারও সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ! ধপ করে ছিটকে পড়লো দূরে। মুখ থেকে চাপা একটা শব্দ বের হলো,
“আহহ…!” more....
সিঁড়ির কোনার সাথে কজ্বি লেগে কেটে গেছে, সামান্য র'ক্ত বেরিয়ে আসছে। রিদিতা চোখ বন্ধ করলো, হাত দিয়ে কজ্বি চেপে ধরলো। একটু সামলে নিয়ে উপরের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। যার সাথে সংঘর্ষ হয়েছিলো, সেও মেঝেতে পড়ে আছে। লম্বা-চওড়া গড়নের একজন পুরুষ, ধবধবে ফর্সা ত্বক, চুল ব্যাকব্রাশ করে সেট করা, মুখে ক্লিন শেভ। আকাশী নীল রঙের শার্ট পরা, একপাশে তার অফিসিয়াল কালো ব্যাগটা পরে আছে। রিদি চোখ পিটপিট করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ঠিক তখনই রান্নাঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলেন আহাদের ছোট চাচি, হালিমা বেগম। চোখে ভ'য় মিশ্রিত বিস্ময়,
“আদনান বাবা, তুমি ঠিক আছো? … রিদিতা!”
পেছন থেকে আহিয়া দৌড়ে নেমে এসে রিদিকে হাত ধরে দাঁড় করালো।
“রিদি..! তুই ঠিক আছিস তো?”
রিদি ব্যথা চাপা দিয়ে মাথা নেড়ে বললো,
“হুম… আমি ঠিক আছি, কিন্তু উনি…”
আহিয়া দ্রুত ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলো।
“আদনান ভাই, আপনি ঠিক আছেন?”
আদনান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। হাত দিয়ে জামার ধুলো ঝাড়লো। একবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো আহিয়ার দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঠাণ্ডা কিন্তু ভীতিকর। আহিয়া অনায়াসে গুটিয়ে গেলো, সেই দৃষ্টিতে যেনো অদৃশ্য চাপা কিছু লুকিয়ে আছে।
আদনান হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে সোজা স্বাভাবিক গলায় বললো,
“আমি ঠিক আছি, চাচি আম্মা।”
এরপর রিদিতার দিকে একবার তাকিয়ে ব্যাগ হাতে তুলে গটগট করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেলো। মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো তার উপস্থিতি। রিদিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো তার চলে যাওয়া পথের দিকে। সে কৌতুহল সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
“উনি কে?”
হালিমা বেগম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন,
“আদনান, আহাদের বড় চাচা সালমান মীরের একমাত্র ছেলে।”
আহিয়া এবার যোগ করলো,
“আদনান ভাই একজন ডাক্তার। বড় আব্বু আর বড় আম্মু জার্মান থাকেন, সেখানে ব্যবসা আছে। আদনান ভাই সেখান থেকেই পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছে। উনি সবার থেকে একেবারেই আলাদা… রাজনীতি একদম পছন্দ করে না, একেবারে বড় আব্বুর মতো। খুব নিয়মে চলে, শরীর নিয়ে প্রচণ্ড সচেতন। প্রয়োজন ছাড়া কারও সাথে কথাও বলে না। দেখলি না, কেমন গটগট করে চলে গেলো?”
রিদি একবার সেদিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। আহিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
“আমি এমনি এমনি বলেছিলাম যে তোদের বাসার সবাই অদ্ভুত। একেকজনের একেক রকম আচরণ।”
আহিয়া আর কোনো জবাব দিলো না। রিদি ঘুরে চলে যেতে নিলেই হালিমা বেগম ডেকে বললেন,
“আরে.. কই যাও? আমি নাস্তা রেডি করেছি। অন্তত খেয়ে যাও।”
“না আন্টি, আমার দেরি হয়ে যাবে। বুবু ফোন দিয়েছে, ভাইয়া বাসায় ফেরার আগেই আমাকে যেতে হবে।”
“এটা আবার কেমন কথা? তোমাকে ড্রাইভার দিয়ে পৌঁছে দেবো।”
রিদিতা দ্রুত মাথা নেড়ে বললো,
“না না, দরকার নেই। আমি যেতে পারবো।”
এরপর রিদি হালকা হাসি দিয়ে সবার থেকে বিদায় নিলো।
আহিয়া হাত নেড়ে বললো,
“সাবধানে যাস! বাসায় পৌঁছে একটা নক দিস।”
রিদিও হাত নেড়ে বেরিয়ে গেলো বাইরে। হালিমা বেগম আবার রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আদিবা ড্রইং রুমে বসে আছে। আহিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আর উপরের তলা থেকে…
আদনানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জোড়া নীরবে বিদ্ধ হয়ে রইলো নিচতলার ড্রইংরুমে। চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা যেনো ভেতরে লুকিয়ে আছে অজানা গল্প, অচেনা রহস্য।
মীর হাউজের বিশাল গেট পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রিদিতা। রাস্তার বাতিগুলো এক এক করে জ্বলে উঠছে, আলো-অন্ধকারের ফাঁকে শহরটা যেনো আরো রহস্যময় হয়ে উঠেছে। রিদি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলালো। একটা রিকশাও চোখে পড়লো না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওড়নাটা শক্ত করে গলায় পেঁচালো, মাথা ও চুল ভালোভাবে ঢেকে নিলো। ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে। বড় বড় পা ফেলে সামনের গলির দিকে হাঁটা শুরু করলো রিদি। আশা ছিলো সেখানে হয়তো রিকশা পাওয়া যাবে।
হঠাৎই পিছন থেকে কর্কশ শব্দে তীব্র ব্রেক কষলো একটা গাড়ি। রিদি চমকে উঠলো একেবারে তার সামনেই কালো রঙের গাড়ি থেমে গেছে! চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো সে, বুক ধুকপুক করছে, আরেকটু হলেই তো… চাকার নিচে যেতো। ঠিক তখনই ভেসে এলো এক অতি পরিচিত গভীর কণ্ঠস্বর,
“মিস জানু..!”more....
তড়াক করে চোখ মেলে তাকালো রিদি। গাড়ির কাঁচ নামানো, ভেতর থেকে ঠাণ্ডা অথচ জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে আহাদ রাজা। তার সেই দৃষ্টি যেনো সরাসরি বিদ্ধ হয়ে ঢুকে গেলো রিদির চোখের গভীরে। অকারণে বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো রিদি। এমন অদ্ভুত ব্যথা সে আগে কখনো অনুভাব করেনি। নিজেকে সামলে নিয়ে কড়া গলায় বললো,
“আর একটু হলেই তো আপনার গাড়ির নিচে ব্যাঙের মতো পিষে যেতাম আমি! চোখ কি পকেটে রেখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন?”
আহাদ ধীরস্থির ভঙ্গিতে গাড়ির দরজা খুলে নেমে এলো।
তার চোখ এখনো স্থির হয়ে আছে রিদির মুখে। ঠাণ্ডা, কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো স্বরে বললো,
“কি বললে, হুম?”
আহাদের কণ্ঠে হিমশীতল রাগ মিশে আছে। রিদি সেটা বুঝে গেলো, বুকের ভেতর আরও জোড়ে ধুকপুক শুরু হলো। আর কথা না বাড়িয়ে একটা কৃএিম হাসি দিলো, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো। ঠিক তখনই সামনে এক ফাঁকা রিকশা এসে পড়লো। রিদি তাড়াতাড়ি ডাক দিলো,
“এই রিকশা!”
রিকশা কাছে আসতেই রিদি দ্রুত পা বাড়িয়ে উঠতে যায়।
হঠাৎ একটা শক্তপোক্ত হাত তাকে কোমর থেকে টেনে তুললো। ভড়কে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো রিদি,
“আআ…! মামা, বাঁচান! এই লোকটা আমাকে অপহরণ করছে!”
তার চিৎকারে আশেপাশের কয়েকজন সেদিকে তাকালো, রিকশাওয়ালা ও একবার আহাদের দিকে তাকালো। আহাদের চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে রিকশাওয়ালা এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত প্যাডেল মেরে উধাও হয়ে গেলো। রিদির মুখ শুকিয়ে গেলো।
“এই দেশে মানবতা বলে কিছু নাই! কেউ সাহায্য করলো না…”
আহাদ একটুও বিচলিত হলো না। বরং তাকে তুলে এনে গাড়ির ভেতর বসিয়ে, নিজে হালকা ঝুঁকে মুখের কাছে এসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
“কে বলল মানবতা নাই? এই যে আমি একটা মহিলা ব্যাঙকে তুলে, এতো কষ্ট করে চার ফুট হেঁটে এসে গাড়িতে বসালাম। এটা কি মানবতার মধ্যে পড়ে না?”
রিদির চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেলো। মুখ হা হয়ে রইলো।
আহাদ গা ছাড়া ভঙ্গিতে সামান্য হেসে উঠলো। রিদি দাঁত চেপে কোমল দু’হাতে আহাদের বুক ঠেলে সামান্য সরিয়ে দিলো।
“আমি মোটেও ব্যাঙ না! ব্যাঙ আপনি… আপনার চৌদ্দ ঘুষ্টি! সরুন, আমি নামবো।”
সে পা নামানোর আগেই আহাদ ধপ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিলো তার মুখের উপর। অতঃপর হেঁটে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। গাড়ির ইঞ্জিন গর্জে উঠলো, সামনে-পিছনে গার্ডদের গাড়ি সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো।
ধীরে ধীরে কনভয়ের মতো যাত্রা শুরু হলো। আর গাড়ির ভেতরে বসে রিদি নিঃশ্বাস ফেললো ভারীভাবে। তার বুকের ভেতর ধড়ফড়ানি থামছেই না।
আহাদ দু’হাত স্টিয়ারিংয়ে রেখেও মাঝে মাঝে পাশ কাটিয়ে তাকাচ্ছিলো রিদির দিকে। তার দৃষ্টি এমন, যেনো রিদির প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি, প্রতিটা নিঃশ্বাসের ওঠানামা পর্যন্ত পড়ে ফেলতে চাইছে। রিদির শরীর থেকে ভেসে আসছে মেয়েলি ঘ্রাণ। হালকা, মিষ্টি, অথচ অদ্ভুতভাবে মাতাল করা। আহাদ রাজা মীর, যে মানুষের র'ক্ত ঝরাতে দ্বিধা করে না, যার কণ্ঠেই মানুষ থরথর করে কাঁপে, সে আজ অদ্ভুত অচেনা এক অনুভূতির বন্দী। বুকের ভেতর ধুকপুক ধ্বনিতে যেনো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে হৃদপিণ্ড। কপালের শিরাগুলো টনটন করছে। সে মাথা নাড়িয়ে চেষ্টা করলো সবকিছু ঝেড়ে ফেলতে। কিন্তু যতই চোখ সরায়, ততই আবার দৃষ্টি ফিরে যায় রিদির দিকে।
হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে গেলো। রিদির কজ্বিতে হালকা কা'টা দাগ, র'ক্ত শুকিয়ে লেগে আছে। আহাদের দু ভ্রুর মাঝখানে গভির ভাঁজ পরলো। চোখ দুটো একেবারে ধারালো হয়ে উঠলো। হঠাৎই ব্রেক চাপলো জোরে। গাড়ি কেঁপে উঠলো রাস্তার মাঝে। সামনে-পিছনে থাকা গার্ডদের গাড়িগুলোও দাঁড়িয়ে গেলো। আহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রিদির হাতে,
“এটা কি? এখানে কি হয়েছে!”
রিদি চমকে গেলো, একটা ঢোক গলাধঃকরণ করে আমতা আমতা করে বলল,
“পড়ে গিয়ে একটু কেটে গেছে…”
আহাদ গর্জে উঠলো,
“পড়ে যাস কি করে? আর কেটে যায় কি করে? হুহ! মন কি তালগাছের মাথায় থাকে?”
রিদি ভয়ে আর কিছুই বললো না। তবে মনে মনে বিড়বিড় করলো,
“আজব! আমার কেটে গেলে উনির কি? নিজে তো খালি থাপ্পড়ায়, ধমকায়। আর এখন দরদের ডিব্বা হয়ে মরিচের মতো ঝাঝ ঢালছে!”
আহাদের চোখ স্থির হয়ে রইলো। রিদির ঠোঁট ফুলানো, চোখ দুটো ভীতুর মতো পিটপিট করছে, দৃষ্টি সোজা সামনের দিকে। কোনো কথা না বলে আবার গাড়ি চালু করলো আহাদ। কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে থামলো একটা বড় ফার্মেসির সামনে। গাড়ির ভেতর রিদিকে লক করে রেখে নেমে গেলো সে। রিদির বুক ভ'য়ে ধড়ফড় করছে, সে অপেক্ষা করতে লাগলো। more....
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো আহাদ রাজা, হাতে একগাদা ওষুধের প্যাকেট। গাড়িতে বসে রিদির হাত ধরে জোর করে সামনে টানলো। রিদি বাধ্য মেয়ের মতো হাত বাড়িয়ে ও দিলো। আহাদ হেক্সিসল দিয়ে পরিষ্কার করে, খুব যত্ন করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। যেনো তার সব ধৈর্য ঢেলে দিচ্ছে। রিদির বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত কাঁপন শুরু হলো। পানির বোতলের ঢাকনা খুলে দুইটা ওষুধ এগিয়ে দিলো আহাদ। রিদি সাথে সাথে ঠোঁট ফুলিয়ে নাক চেপে ধরলো। আহাদ হুংকার ছাড়লো,
“কি হলো! আর কতক্ষণ ধরে থাকবো আমি?”
রিদি ভ্রু কুঁচকে কটাক্ষ করে বলল,
“আপনাকে ধরে রাখতে কে বলেছে? জানালা দিয়ে ফেলে দেন না! সামান্য কেটে গেছে, এমনই ঠিক হয়ে যাবে।”
আহাদের চোখে আগুন জ্বলে উঠলো।
“আহাদ রাজার মুখের উপর কথা! থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো। হা কর!”
সে রিদির চিবুক ধরে মুখ উঁচু করলো। রিদি চোখ বন্ধ করে শ্বাস রুদ্ধ করে রাখলো। ভয়ে বাদ্য মেয়ের মতো মুখ খুলে ওষুধটা গিলে ফেললো। আহাদ তখন ধীরে তার চিবুক ছাড়লো। নরম স্বরে বললো,
“এবার নিশ্বাস নে, তা না হলে মরে যাবি। পরে আমিও অনায়াসে মরবো, আমার এত তাড়াতাড়ি মরার শখ নাই।”
রিদি চোখ খুললো, হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আহাদের দিকে। শেষের কথাগুলো সে ঠিকঠাক শুনতে পেলো না। আহাদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কি বলেছে।
একসময় গাড়ি এসে থামলো রিদির বাসার সামনে। রিদি নামতে যাবার আগেই আহাদ তার হাতে ধরিয়ে দিলো ওষুধের প্যাকেটগুলো। রিদির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো।
“এতগুলো ওষুধ! সামান্য একটা কাটার জন্য?”
আহাদ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“সব ধরনের ব্যথার ঔষধ, দাগ যাওয়ার ক্রিম আছে। যেটা ভালো লাগে সেটা খাবে।”
রিদি হতভম্ব হয়ে বললো,
“এহহ! ওষুধও আবার পছন্দমত খাওয়া যায়?”
আহাদ নাক ঘষলো হাতের উল্টোপিঠে।
“যায়। ভালো না লাগলে ডাক্তার দেখিয়ে অন্য ওষুধ এনে দিবো।”
রিদি একেবারে চুপ করে গেলো। মনে মনে বলল,
“বড়লোকের বিড়াট কারবার… এরা বোধহয় এভাবেই ট্রিটমেন্ট করে।”
একটা ভাড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত ভিতরে ঢুকে গেলো। আহাদ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। ছয়'তলার করিডোরে এসে থামলো রিদি। চোখ পড়লো কর্নারের ডাস্টবিনে। হাতে থাকা ওষুধের প্যাকেটগুলোর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটলো। চারদিকে চোরের মতো তাকালো একবার। অতঃপর একেবারে নিশ্চিন্তভাবে সব ওষুধের প্যাকেটগুলো ছুড়ে দিলো ডাস্টবিনে। দু’হাত ঝেড়ে বললো,
“ ব্যাস... ঝামেলা শেষ.! বাসায় এগুলো নিয়ে ঢুকলে নিশ্চিত হরতাল হতো।”
বাসায় ঢুকেই রিদি হাঁফ ছেড়ে দিলো। দরজার পাশেই রাখা সোফায় গা এলিয়ে দিলো, তার দেহ ক্লান্ত। চোখে-মুখে ক্লান্তি আর অস্থিরতা স্পষ্ট। সামনে এসে বসল ঈশানী। বোনকে একবার ভালো করে পরখ করলো সে। কিছুদিন ধরেই রিদির আচরণ তার চোখে ধরা পড়ছে, কেমন যেন উদ্ভট, অস্বাভাবিক। ঈশানী ভ্রু কুঁচকে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো, more....
“এত দেরি করলি যে! বেরিয়েছিলি মাগরিবের সময়, এখন এশার আজান দিচ্ছে।”
রিদি একটু কাত হয়ে আড় চোখে তাকালো বোনের দিকে।
মৃদু ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,
“দেরি কোথায় করলাম! রাস্তায় জ্যাম ছিলো। ভাইয়া কি আসছে?”
“না, এখনই চলে আসবে। মাগরিবের নামাজ তো ক্বাযা করেছিস। এখন অন্তত ওযু করে এশার পড়ে নে। একটু পরেই আব্বু ফোন দিবে, নামাজ পড়ছিস কিনা জিজ্ঞেস করবে।”
রিদি নিঃশ্বাস ফেলে কপাল ম্যাসেজ করলো।
“ক্লান্ত লাগছে… ভালো লাগছে না, একটু পরে পড়বো।”
ঈশানী তির্যক দৃষ্টিতে তাকালো।
“এখন না পড়লে আর হবে না। একবার চিৎপটাং হয়ে গেলে আর উঠবি না।”
রিদি ঠোঁট ফুলিয়ে বিরক্ত মুখে বললো, “আচ্ছা যাচ্ছি!”
ধপধপ পা ফেলে রুমে ঢুকে ব্যাগটা ছুড়ে দিলো বিছানায়।
তারপর ভারি পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে নিলো।
ওযু শেষে এসে শান্ত হয়ে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষ করে জায়নামাজ গুটিয়ে রাখতেই মাহির ডাক এলো,
“খালামনি! মাম্মাম ডাকছে। নানু ভাই ফোন দিছে।”
রিদি ভ্রু কুঁচকে তাকালো, অনিচ্ছা সত্ত্বেও জায়নামাজ রেখে মাহির সঙ্গে গেলো ড্রয়িংরুমে। স্ক্রিনে বাবার মুখ।
রিদি সালাম দিলো। রিদিকে হিজাবে দেখে তার বাবা সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণ কণ্ঠে উত্তর দিলেন,
“মাশাআল্লাহ! আমার আম্মাজান নামাজ পড়ে আসছে মনে হয়।”
রিদি মাথা নীচু করে হালকা হাসলো। তার বাবা আবার দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“নামাজ কায়েম করবা না মা। দুনিয়ার সব কিছুই মিথ্যা, মায়াজ্বাল। শুধু তোমার ইবাদতগুলোই আসল। এগুলোর দিকে সবসময় খেয়াল রাখবা।”
অতঃপর দীর্ঘ সময় নিয়ে কিছু উপদেশ দিলেন। হাদিস শোনালেন, যেন প্রতিদিনের নিয়ম। ঈশানী আর রিদি, দু’জনেই মাথা নিচু করে শুনলো মনোযোগ দিয়ে। একসময় ঈশানী জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মু কেমন আছে? রাইসা পড়াশুনা করে?”
“তোমার আম্মু নামাজ দাঁড়িয়েছে। রাইসা… রুমে কি করে কে জানে! কোনো কথা শোনে না তোমার আম্মুর।”
তারপর রিদির দিকে তাকিয়ে গলা কঠিন করলেন,
“তোমার পড়াশোনার কি খবর? ঠিক মতো পড়াশোনা করো?”
রিদি সোজা হয়ে বসল, “হুম করি তো!”
তারেক রায়ান গম্ভীর মুখে বললেন,
“তোমাকে আমি আসলে সেখানে পাঠাতে চাইনি। তোমার ভাই-বোন মিলে ভর্তি করাইছে। ভর্তি যখন হইছো, মন দিয়ে পড়বা। কোনো কিছু যেনো না শুনি, এমন কিছু করবা না যাতে তোমার আব্বুকে সমাজে মাথা নিচু করে হাঁটতে হয়।” more....
রিদি কিছু বললো না, শুধু মাথা নাড়লো। চোখে এক অদ্ভুত চাপা ভ'য় জমে উঠলো। তিনি আবার বললেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে। তো ভালো থাকো। সাবধানে চলাফেরা করবা। আল্লাহ হাফেজ।”
দুই বোন একসাথে বললো, “আল্লাহ হাফেজ।”
ভিডিও কল শেষ হতেই রুমের ভেতর হালকা নীরবতা নেমে এলো। রিদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় বসে চার হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে দিলো, সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রইলো আনমনস্কভাবে। মনে পরে বাবার শেষ কথাটা,
“এমন কিছু করবা না যাতে তোমার আব্বুকে সমাজে মাথা নিচু করে হাঁটতে হয়।”
চোখ দুটো বন্ধ করলো। শরীরটা ক্লান্ত, মনটাও ভারাক্রান্ত। ঠিক তখনই ট্রিঁইইইং… ট্রিঁইইইং… করে বেজে উঠলো কলিং বেল। ঈশানী ঝট করে উঠে দাঁড়ালো।
“তোর ভাইয়া আসছে মনে হয়।”
বলেই দৌড়ে গেলো দরজার দিকে। দরজা খুলতেই চোখ বড় বড় হয়ে গলো ঈশানীর। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন পরিচিত মুখ। আহাদ রাজার তিন পান্ডা শাহীন, নাদিম আর শাওন। তাদের হাতে ও নিচে একাধিক বড় বড় প্যাকেট। দেখে মনে হচ্ছিলো, সব খাবারের প্যাকেট।
ঈশানী বিস্মিত হয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললো,
“আ.. আপনারা…?!”
রিদি চোখ বন্ধ রেখেই শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো। চোখ খুলে ঘার একটু কাত করে দেখার চেষ্টা করলো। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো ঈশানীর পেছনে। সামনের দৃশ্য দেখে রিদির চোখও বিস্ফারিত হয়ে গেলো, আহাদের তিন পান্ডাকে দেখে। ঠিক তখনই শাহীন প্যাকেটগুলো এগিয়ে ধরলো। নরম অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এগুলো আপনার জন্য।”
ঈশানী রিদির উপস্থিতি টের পেলো না, তাই ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে তাকালো তাদের দিকে।
“আমার জন্য?”
তিনজন একসাথে দ্রুত না সূচক মাথা নাড়লো। তারপর ঈশানীর পিছনে রিদির দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
“আপনার জন্য।”
রিদি হতবাক হয়ে নিজের বুকে তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে বলে, “আমার জন্য?”
তিনজন একসাথে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। এরপর শাহীন প্যাকেট গুলো ধরে রেখে ব্যাখ্যা দিলো,
“আপনার হাত কেটে গেছে। ভাই বলেছে আপনার প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে। তাই এগুলো পাঠিয়েছে। অনুগ্রহ করে গ্রহণ করুন।”
এক মুহূর্তে ঘরটা যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। শুধু রিদির বুকের ভেতর ঢুপঢাপ শব্দের ধুকপুকানি। ঈশানী দৃষ্টি হঠাৎ রিদির দিকে ঘুরে গেলো, চোখ দুটি বিদ্ধ হচ্ছে যেন রিদির বুকের ভেতর পর্যন্ত। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, বিস্ময়ের সুরে বললো,
“তোর হাত কেটে গেছে?”
রিদি একটা শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো। গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। অবস্থা এমন যে কথাই বেরোতে চাইছে না। অবশেষে বএিশ টা দাঁত বের করে জোর পূর্বক একটা কৃত্রিম হাসি দিলো। বিড়বিড় করে সুর টেনে বলল,
“আমি তো ফাইসা গেছি… ও.. আমি তো ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়…”
ঈশানী কটমট করে তাকালো রিদির দিকে, আহাদ রাজার তিন পান্ডা একএক করে ভিতরে ঢুকে গেলো। সব প্যাকেট গুলো ড্রইং রুমে রেখে আবার বেড়িয়ে গেলো। পুরো ড্রইং রুম ভর্তি, পা রাখারও জায়াগা নাই। রিদিতা ভয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, মনে মনে আহাদ রাজাকে গালি দিতে লাগলো,
“সামান্য একটু কেটে গেছে, তার জন্য আবার কিসের প্রোটিন আজব!” more....

No comments:

720

Powered by Blogger.