🌺 গল্প: শেষ বিকেলের আলো
অধ্যায় – ১ : প্রথম পরিচয়
নীলফামারীর ছোট্ট শহরটা শান্ত, চারপাশে সবুজ আর মাঝখানে বয়ে যাওয়া নদী যেন শহরের প্রাণ। সেই শহরেই দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো সরকারি কলেজ। লাল ইটের দালান, সামনে বিশাল মাঠ, আর পাশে গাছগাছালি। প্রতিদিন সকালে ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে জায়গাটা।
সেই কলেজেই ভর্তি হয়েছিল রূপা। মেয়েটি প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, বন্ধুদের আড্ডায় সবসময় কেন্দ্রে থাকে। তার চোখে অদ্ভুত এক আলো, যা কাউকে একবার দেখলেই থমকে যেতে বাধ্য করে।
অন্যদিকে অরিন্দম। শান্ত স্বভাবের, পড়াশোনায় মনোযোগী। সে খুব একটা কথা বলে না, কিন্তু ক্লাসে সবসময় প্রথম সারির ছাত্র। সহপাঠীরা মাঝে মাঝে বলে—
— “ওই ছেলেটা যেন অন্য জগতের।”
প্রথম বর্ষেই রূপার সঙ্গে অরিন্দমের পরিচয় হলো। লাইব্রেরিতে রূপা একদিন ইতিহাসের বই খুঁজছিল। অনেক খুঁজেও পাচ্ছিল না। তখনই অরিন্দম এগিয়ে এসে তাক থেকে বইটা নামিয়ে দিল।
— “আপনি এটা খুঁজছেন?”
রূপা হেসে মাথা নাড়ল।
সেদিন থেকে তাদের মাঝে কথোপকথনের শুরু।
অধ্যায় – ২ : বন্ধুত্বের বাঁধন
প্রথমে শুধু শুভেচ্ছা বিনিময়, তারপর নোট শেয়ার করা, আবার কখনো একসাথে ক্যান্টিনে বসা—এভাবেই ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গাঢ় হলো।
রূপা লক্ষ্য করল, অরিন্দম সবসময় ভদ্র আর সহানুভূতিশীল। ক্লাসে কারও কলম ফুরিয়ে গেলে সে চুপচাপ নিজের কলম বাড়িয়ে দেয়। কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে বিনা দ্বিধায় সাহায্য করে।
একদিন বৃষ্টির বিকেলে কলেজ ছুটি হলো। সবাই তাড়াহুড়ো করে বাসায় চলে গেল। রূপা ছাতা আনেনি, আর হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামল। সে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে কলেজ গেটের কাছে। অরিন্দম এগিয়ে এসে তার ছাতার অর্ধেকটা বাড়িয়ে দিল।
— “চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিই।”
রূপা হেসে উঠল, ভেজা চুল থেকে জল টপটপ ঝরছে। সেদিন থেকেই তাদের বন্ধুত্বে একটু অন্য রকম রং লাগল।
অধ্যায় – ৩ : প্রথম স্বীকারোক্তি
কয়েক মাস কেটে গেল। পড়াশোনা, আড্ডা, আর একসাথে সময় কাটানোর মধ্যে দিয়ে দু’জনেই বুঝতে পারল—তাদের সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্ব নয়।
এক বিকেলে তারা নদীর পাড়ে বসেছিল। সূর্য ডুবছে, আকাশে লাল আভা। রূপা হঠাৎ বলল—
— “তুমি সবসময় এত চুপচাপ থাকো কেন?”
অরিন্দম একটু চুপ করে থেকে বলল—
— “সব কথা মুখে বলা যায় না। কিছু কথা শুধু চোখ দিয়ে বুঝতে হয়।”
রূপা হেসে ফেলল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুক কেঁপে উঠল।
সেদিনই দু’জনের চোখের ভাষা বলে দিল—এ সম্পর্ক বন্ধুত্বের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে।
অধ্যায় – ৪ : স্বপ্ন আর প্রতিজ্ঞা
অরিন্দম স্বপ্ন দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। রূপার স্বপ্ন শিক্ষক হওয়া। দু’জনেই পড়াশোনায় মনোযোগী।
তারা প্রতিজ্ঞা করল—
— “যে যেখানেই থাকুক, আমরা একে অপরকে হারাব না।”
প্রতিদিন ক্লাস শেষে নদীর পাড়ে বসে তারা ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকত।
— “আমরা দু’জনে একদিন শহরের বাইরে ছোট্ট একটা বাড়ি বানাব, অনেক বই থাকবে, ফুলের বাগান থাকবে।”
রূপা হেসে বলত, আর অরিন্দম নীরবে স্বপ্ন বুনত।
অধ্যায় – ৫ : ঝড়ের দিন
কিন্তু সুখ তো সবসময় টিকে থাকে না। হঠাৎ একদিন রূপার পরিবার তার বিয়ে ঠিক করে দিল। ছেলেটি শহরের বাইরে থাকে, চাকরি করে। রূপা শিউরে উঠল।
সে কাঁদতে কাঁদতে অরিন্দমকে বলল—
— “আমি কী করব? আমি তো শুধু তোমাকেই চাই।”
অরিন্দম চোখ মুছে দিল তার অশ্রু।
— “আমরা হার মানব না। তুমি পড়াশোনা শেষ করবে। আমি লড়াই করব। ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে কোনো বাঁধা আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
অধ্যায় – ৬ : দূরত্বের কষ্ট
অরিন্দম ঢাকা চলে গেল পড়াশোনার জন্য। খরচ চালাতে টিউশনি করত। ভোরে বেরিয়ে রাত অবধি সংগ্রাম, তবুও প্রতিদিন রাতে রূপাকে চিঠি লিখত।
“রূপা, শেষ বিকেলের আলোয় তোমার চোখ মনে পড়ে যায়।
আমি লড়ছি, শুধু তোমার হাত ধরার দিনের অপেক্ষায়।”
রূপাও গোপনে উত্তর লিখত।
“তুমি যদি থাকো, আমি কোনো ঝড়কে ভয় পাই না।”
কিন্তু চাপ বেড়েই চলল। পরিবারের জেদের সামনে রূপা দিনরাত অশ্রু ফেলত। কিন্তু সে সাহস করে বাবাকে বলল—
— “আমি পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করব না।”
অধ্যায় – ৭ : ফিরে আসা
চার বছর পর।
রূপা কলেজের শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেল। অরিন্দমও পড়াশোনা শেষ করে শহরে ফিরল।
সেই প্রথম দেখা হলো আবার নদীর পাড়ে। আকাশে তখনও সূর্য ডুবছে, লাল আভা ছড়িয়ে আছে।
অরিন্দম ধীরে ধীরে রূপার হাত ধরল।
— “দেখলে? আমরা জিতেছি। ভালোবাসা হেরে যায় না, যদি সত্যি হয়।”
রূপার চোখ ভরে উঠল অশ্রুতে। সে ফিসফিস করে বলল—
— “শেষ বিকেলের আলোয় তুমি আমার আজীবনের আলো হয়ে গেলে।”
উপসংহার
তাদের ভালোবাসা জয়ী হলো। সংগ্রাম, দূরত্ব, অশ্রু—সবকিছুকে পেরিয়ে তারা একে অপরের হাতে হাত রাখল।
সূর্য যেমন প্রতিদিন অস্ত যায়, আবার নতুন ভোর নিয়ে আসে, তেমনি তাদের জীবনের প্রতিটি অন্ধকার শেষে আলো এসে দাঁড়াল।
রূপা আর অরিন্দমের গল্প শহরের সবাই জানল, কিন্তু কেউই জানল না কত কষ্ট, কত অশ্রু, আর কত অপেক্ষা লুকিয়ে ছিল সেই ভালোবাসার পেছনে। more...
No comments: