#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী
সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। গাঢ় নীল আকাশের আলোর রঙ ধীরে ধীরে সোনালী হয়ে আসছে। এমন সময়ে যেনো ঝড়ের বেগে রুমের ভেতরে ঢুকলেন আসফাক মীর। চোখ দুটো লাল, মুখে বিরক্তির ছাঁপ। প্রথমেই চারপাশে একবার চোখ বুলালেন। বিছানার উপর ছড়ানো আহাদের পোষাক, আলমারির দরজা আধখোলা। তবে আহাদকে দেখতে পেলেন না কেথাও। তিনি দু’বার ডাক দিলেন,
“আহাদ… আহাদ…”
তখনই ওয়াশরুমের দরজাটা অল্প ফাঁক হলো, ভেতর থেকে ভিজে হাত উঁচু করে জবাব দিলো আহাদ রাজা,
“চাচু, এখানে।”
আসফাক মীরের দৃষ্টি ঘুরে গেলো সেদিকে, ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“এখনো শাওয়ার নিচ্ছিস? ফাস্ট আয়, জরুরি কথা আছে।”
ভেতর থেকে দুষ্টু ভঙ্গিতে দু’আঙুল তুলে ইশারা করলো আহাদ রাজা,
“জাস্ট দুই মিনিট!”
আসফাক মীর হালকা বিরক্ত হলো আহাদের গা ছাড়া ভাব দেখে, গম্ভীর মুখে সোফায় বসলেন। তার ডান পা অনবরত নাড়ছিলেন। কপালের শিরা চওড়া হয়ে উঠেছিলো। দুই মিনিট শেষে ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো আহাদ রাজা। কোমরে সাদা তোয়ালে জড়ানো, ভেজা চুল থেকে শরীর বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এক হাতে আরেকটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এসে দাঁড়ালো চাচার সামনে। শরীরটা উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছে, মুখে নির্লিপ্ত ভাব।
“বলো, কী এত ইমারজেন্সি।”
“খবর শুনছিস, শামিম পোদ্দার তোর সাথে টেক্কা নিচ্ছে। যে কথা দিয়েছিলো এখন মুড়ে গেছে।”
আহাদের মুখ শক্ত হয়ে গেলো। গাড়ো বাদামি চোখ লাল হয়ে উঠলো মুহূর্তেই। সে দাঁত কিড়মিড় তাকালো চাচার দিকে, more....
“এই কথা আমায় বলছো কেনো? কথার বরখেলাফি করলে কী করতে হবে, সেটা কি তোমাকে নতুন করে ট্রেনিং দিতে হবে?”
আসফাক মীর উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দিলেন, “পুরো কথা তো শুনিসই নাই এখনো।”
আহাদ কটমট করে তাকালো, “আর কী শুনবো?”
“লোক পাঠিয়ে তুলে এনেছি পোদ্দারকে। ডেমো ঘরে আছে। এখন শুধু তোর ‘ডেমো’ দেখানো বাকি।”
এইবার আহাদের ঠোঁটে একটা বাঁকা মুচকি হাসি খেলে গেলো। সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে লাগলো। চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক।
“তুমি যাও… ট্রেইলার দেখাও, আমি আসতেছি।”
আসফাক মীর মাথা নেড়ে ভারি পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন।
প্রধান দরজা পেরোতেই সামনে থেকে আসতে থাকা একটা মেয়ের সাথে প্রায় ধাক্কা খেয়ে গেলো, তবে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচালেন। মেয়েটা একেবারেই অচেনা। দেখতে ভীষণ মিষ্টি, বয়স উনিশ-বিশের বেশি হবে না। মেরুন রঙের চুড়িদার পরা, মুখভরা একরাশ মাধুর্য, তবে আচমকা তাকে দেখে ভড়কে থেমে গেলো। কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরলো দুই হাতে। আসফাক মীর কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“এই মেয়ে… কে তুমি? বাসার ভেতর ঢুকলে কী করে?”
মেয়েটা হকচকিয়ে গেলো, নার্ভাস হয়ে নরম কণ্ঠে উত্তর দিলো, “জ্বি… আমি রিদিতা। আহিয়ার ফ্রেন্ড।”
আসফাক মীর একদৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকালেন। একটু পরখ করে নিলেন চোখ বুলিয়ে। অতঃপর ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর সুরে বললেন,
“আগে তো দেখিনি কখনো। আচ্ছা, যাই হোক… তুমি যেতে পারো।”
বলেই তিনি সোজা নিজের গন্তব্যের দিকে হাঁটলেন।রিদিতা পেছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে ফিসফিস করলো,
“কি অদ্ভুত আচরণ!”
তারপর মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকলো। দরজা পেরিয়ে বুক ধড়ফড় করতে করতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। প্রতিটা কদমে ভ'য় কাজ করছিলো, যদি আবার কারো সামনে পড়ে যায় আর সাওয়াল-জবাব শুরু হয়?
ঠিক তখনই তার ভয়টা সত্যি হলো। পিছন থেকে একটা গম্ভীর নারী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এই মেয়ে… কে তুমি? এদিকে এসো।”
রিদির বুক কেঁপে উঠলো। চোখ পিটপিট করে ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালো। ড্রইংরুমের রাজকীয় কুশন-ঢাকা কিং-সাইজ চেয়ারে বসে আছেন মধ্যবয়সী এক নারী। চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা, পরিপাটি শাড়ি, মুখে কঠোরতার ছাঁপ। রিদিতা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলো। বুঝতে পারলো এটা আহিয়ার মা। মাথা নিচু করে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
তিনি ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলেন,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। নাম কী তোমার?”
“জ্বি, রিদিতা রায়ান।”
“তুমি আহিয়ার বন্ধু?”
“জ্বি।”
“বাসা কোথায়?”
“মিরপুর এগারো।”
“এখানের স্থানীয়?”
“জ্বি না, দেশের বাড়ি বরিশালের ভোলা জেলায়। এখানে বোনের বাসায় থেকে পড়াশোনা করি।”
“পরিবারের সবাই কি গ্রামেই থাকে?”
“জ্বি।” more....
“বাবা কী করেন? ভাইবোন ক’জন?”
“আব্বু একজন শিক্ষক, আম্মু গৃহিণী। আমরা চার ভাইবোন। ভাই সবার বড়, নাম ইব্রাহিম। তারপর বোন ঈশানী, এরপর আমি নিজে, আর ছোট একটা বোন আছে রাফিয়া।”
রিদিতা হালকা কেঁপে উঠে এক নিঃশ্বাসে সব বলে দিলো।
আফরোজা শেখ গম্ভীর দৃষ্টিতে রিদিতার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে থেকে নির্লিপ্ত সুরে বললেন।
“ঠিক আছে তুমি যাও, আহিয়া উপরে নিজের ঘরেই আছে।”
রিদিতা মাথা নাড়িয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। বুক থেকে চাপা ভ'য়'টা যেনো একটু হলেও সরে গেলো।
পিছনে বসে আফরোজা শেখ গভীর দৃষ্টিতে মেয়েটির চলে যাওয়া দেখতে লাগলেন। ঠোঁট শক্ত করে কিছু একটা ভাবলেন মনে মনে। তারপর আঙুলের ডগা দিয়ে চশমার ফ্রেমটা ঠিক করে আবার হাতে ধরা ফাইলের দিকে মন দিলেন।
★
রিদিতার মনে হঠাৎ করে আহিয়ার উপর অভিমান জেগে উঠেছিল। ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে কাঠের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই মুখ থেকে বের হয়ে এলো,
“আহিয়ার... বাচ্চা...!”
কথাটা শেষ করার আগেই পাথরের মূর্তির মতো জমে দাঁড়িয়ে গেলো দরজার সামনে। চোখ বড় বড় হয়ে গেলো, নিঃশ্বাস যেন আটকে গেলো বুকের ভেতর। তার থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে আহাদ রাজা মীর!
অর্ধনগ্ন অবস্থায়, কেবল একখানা কালো ট্রাউজার পরে। ঘরের মৃদু আলোয় চকচক করছে তার কাঁধ, বুক আর অ্যাবস। শক্তপোক্ত শরীরটা যেন জীবন্ত ভাস্কর্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
রিদিতার গলা শুকিয়ে এলো, নিজের অজান্তেই ঘাড় একটু কাত হয়ে গেলো, ওষ্ঠ জোড়া ফাঁক হয়ে দৃষ্টি আটকে গেলো আহাদের শরীরে। সে যেন চোখ ফেরাতেই পারছিল না। আহাদ ধীর পায়ে দু’কদম এগিয়ে এলো তার দিকে। রিদির নিঃশ্বাস হালকা কেঁপে উঠলো। আহাদ ঝুঁকে তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
“আহিয়ার তো বাচ্চা নাই। তবে আপনি চাইলে আমরা একটা ছোটখাটো ক্রিকেট টিম বানাতেই পারি, মিস জা..নু..!”
রিদিতার দৃষ্টি এখনো আটকে আছে তার শরীরের দিকে। অবচেতনভাবে তর্জনী আঙুল বাড়িয়ে দু’বার স্পর্শ করলো আহাদের চকচকে বুকে, মনে হলো যেন ছুঁয়ে নিশ্চিত হতে চাইছে, এটা বাস্তব নাকি কল্পনা। আহাদ কিছু না বলে শুধু অদ্ভুত তৃষ্ণায় ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ রিদিতা চমকে উঠলো, তীব্র চিৎকার দিয়ে পেছনে সরে গেলো। তার পিঠ গিয়ে ঠেকলো কাঠের দরজার । চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলল,
“আ… আপনি? এ… এখানে? আপনি আহিয়ার রুমে কি করছেন?”
আহাদ শান্তভাবে বাম হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা নাকটা ঘষে নিলো। অতঃপর বিছানা থেকে শার্টটা তুলে গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে উত্তর দিলো,
“ফার্স্ট অফ অল, এটা আহিয়ার রুম না। এন্ড সেকেন্ডলি, আমার বাড়িতে, আমার রুমে দাঁড়িয়ে আমাকেই প্রশ্ন করছেন আমি এখানে কি করছি! ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং!”
রিদিতার চোখ আরও বিস্ময়ে বড় হলো।
“আপনার বাড়ি..?”
আহাদ এবার দুই কদম এগিয়ে এসে সামান্য ঝুঁকে মুখোমুখি দৃষ্টি মেলালো। কন্ঠে রুক্ষ দৃঢ়তা,
“ইয়েস। ভালো করে তাকিয়ে দেখ জানু, কোন দিক থেকে এটা আহিয়ার রুম মনে হয়?”
রিদিতা তখন ধীরে ধীরে চোখ বুলাতে লাগলো চারপাশে। সত্যিই তো রুমটার প্রতিটি কোণ যেন পুরুষালী রুচিতে সাজানো। বড় বড় দুটো অদ্ভুত পেইন্টিং টাঙানো দেয়ালে, অন্যপাশে ঝুলছে দুটো গিটার একটা বাসন্তী, আরেকটা কফি মেরুনের সংমিশ্রণ। দেয়ালের অন্য পাশে ঝোলানো কিছু বক্সিং গ্লাভস, কোণের স্ট্যান্ডে ঝুলছে একাধিক ব্লেজার। আরেক কোণে ড্রেসিংরুম। রুমটা বড়, পরিপাটি, অথচ রুক্ষ। সেদিন এসবের কিছুই খেয়াল করেনি রিদিতা, মনে মনে ফিসফিস করলো,
“মানে গেটের সামনে যে মীর হাউজ লেখা ছিলো… তার মানে এটা আসলেই আহাদ রাজা মীরের বাড়ি! ইশশ, কি বুদ্ধু আমি, এখন কি বলবো, কিভাবে বের হবো এখান থেকে?”
ঠিক তখনই আহাদ হঠাৎ দু’আঙুলে তুরি বাজিয়ে তার ধ্যান ভাঙলো।
“কি হলো? কোথায় হারিয়ে গেলেন, মিস জানু!”
রিদি লজ্জা আর ভয়ে গুটিয়ে গেলো। কণ্ঠ কাচুমাচু, অপরাধী ভঙ্গিতে বলল,
“আসলে আমি জানতাম না… আহিয়ার রুম ভেবে ভুল করে চলে এসেছি। আ… আমি যাচ্ছি…”
সে দ্রুত ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে বজ্রকণ্ঠে ভেসে এলো আহাদের ডাক,
“স্টপ!”
পায়ের তলা কেঁপে উঠলো রিদির। ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালো। আহাদের কড়া দৃষ্টি সরাসরি তীরের মত বিদ্ধ হলো তার চোখে। আহাদ দু’আঙুলের ইশারায় কাছে ডাকলো। রিদিতা থমকে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, অতঃপর কাঁপতে কাঁপতে তার দিকে এগিয়ে এলো। আহাদের সামনে এসে মাথা নিচু করে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়ালো। আহাদ গম্ভীর গলায় বলল,
“আমার কাছে ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। ভুল যখন করেছিস, এর শাস্তিটাও নিয়ে যা, জানু।”
রিদিতা ভয়ে তখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ আহাদ হুংকার ছাড়লো,
“ওই চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়া!”
রিদিতা কাঁপা গলায় অনুনয় করলো, “আমি সত্যিই জানতাম ন…”
আহাদ ঠান্ডা স্বরে গর্জে উঠলো,
“আমি দ্বিতীয়বার রিপিট করবো না, রিদি। ডু ইট!”
অবশেষে রিদিতা ধীরে ধীরে চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়ালো। তার দৃষ্টি নামানো, ঠোঁট কাঁপছে তিরতির করে। আহাদ এবার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“এবার কান ধর।”
রিদিতা বাধ্য মেয়ের মতো দু’হাত তুলে কান ধরলো।
আহাদ এবার রিদিতার কাছাকাছি এসে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল,
“যতক্ষণ না আমি রেডি হচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবি। কোন চালাকি করার চেষ্টা করলে থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো।”
আহাদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের শার্টের কলার ঠিক করতে লাগলো। চুলে হাত বুলিয়ে মাঝে মাঝে আড়চোখে রিদির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে ফেলে। মেয়েটির লাজমাখা মুখ দেখে বুকের ভেতর অদ্ভুত প্রশান্তি বয়ে গেলো। ইচ্ছে করছিলো এই মুখটার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতে। কয়েক মিনিট পর ঘড়ি হাতে বাঁধতে বাঁধতে বলল,
“ওকে, টাইম আপ। এবার নামতে পা…”
কথাটা শেষ হবার আগেই রিদিতা এক লাফে চেয়ার থেকে নেমে পড়লো। এরপর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ভোঁ দৌড় দিলো দরজার দিকে। রিদিতার এমন কান্ডে আহাদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তার মুখ হাঁ হয়ে গেলো বিস্ময়ে। সে বুঝতেই পারে নি রিদি এমন কান্ড করে যাবে। এক মূহুর্ত পর হঠাৎ করেই জোরে হেসে উঠলো। মাথা নেড়ে বলল,
“এই মেয়েটা একদিন আমাকেই হার মানাবে নিশ্চিত।”
হাসতে হাসতেই শার্টের শেষ বোতামটা লাগিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো আহাদ রাজা মীর।
★
অবশেষে কয়েকটা রুম ঘুরে ঘুরে হাঁপাতে হাঁপাতে আহিয়ার রুমে এসে পৌঁছালো রিদি। বুকের ভেতর যেনো ধুকপুক শব্দটা গোটা করিডোরেই শোনা যাচ্ছে। ভেতরে ঢুকতেই আহিয়া তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলো। চোখে বিস্ময়, কণ্ঠে দুশ্চিন্তা,
“কিরে তুই ঠিক আছিস? এমন হাঁপাচ্ছিস কেনো?”
রিদিতা হাত উঁচু করে হা করে শ্বাস নিতে নিতে বললো,
“বলতেছি… আগে পানি দে দোস্ত।”
আহিয়া তাড়াতাড়ি টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি ঢেলে এগিয়ে দিলো। রিদি শ্বাস রুদ্ধ করে এক নিশ্বাসে পুরোটা খেয়ে নিলো। একাধিকবার গভীর নিশ্বাস টেনে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো। গ্লাসটা টেবিলো রাখতেই হঠাৎ রিদিতা ঝটকা মেরে আহিয়ার দিকে তাকালো,
“তোদের বাড়ির সবাই এমন অদ্ভুত কেনো?”
আহিয়া ভ্রু কুঁচকে অবাক হলো,
“কেনো, কী হয়েছে?”
“বাসায় ঢুকতেই প্রথমে এক অচেনা লোকের সাথে দেখা হলো, এমন অদ্ভুত আচরণ করলো যে মনে হলো আমি যেনো চোর-বদমাশ! তারপর তোর মা আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো। এক মুহূর্তের জন্য সত্যিই মনে হলো আমি যেনো আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, আর তোর মা কোর্টে বসা অ্যাডভোকেট হয়ে আমাকে জেরা করছে!”
আহিয়া ফিসফিস করে হেসে ফেললো, “ঠিকই মনে হয়েছে তোর।”
রিদিতা হতভম্ব হয়ে তাকালো, “কিহহহ?”
“হ্যাঁ, আমার আম্মু একজন অ্যাডভোকেটই। অ্যাডভোকেট আফরোজা শেখ। দেশের নামকরা ক্রিমিনাল ল’য়ার।”
রিদিতা চমকে উঠলো। মুখ হাঁ হয়ে গেলো,
“আরে বাপ রে! আর কী কী বাকি আছে বল! তোর বাবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, তোর ভাই আহাদ রাজা মীর! আর কিছু বাকি আছে নাকি, আহি?”
“এভাবে কেনো বলছিস?”
“আর কিভাবে বলবো? তুই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর মেয়ে অথচ এই কয় মাসে আমরা একটুও আঁচ করতে পারলাম না!”
আহিয়ার নিচু গলায় বললো,
“কারণ সবাই বাবা আর ভাইয়ের ভয়ে দূরে সরে যায় আমার থেকে। ভয়ে কেউ আমার সাথে মিশতে চায় না। তাই তোদের কখনো বলিনি। ভয় ছিলো যদি তোরাও দূরে সরে যাস…”
“আহি… পাগল তুই! কে কী করলো, কে কী বললো তোর পরিবার কেমন, আমার পরিবার কেমন, তাতে আমাদের কী যায় আসে? আমরা ফ্রেন্ড হয়েছি মানে এই বন্ধুত্ব থাকবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।”
কথাটা শুনে আহিয়ার চোখে পানি টলমল করে উঠলো। আবেগে সে রিদিতাকে জড়িয়ে ধরলো। রিদিতাও আলতোভাবে ওকে শান্তনা দিলো। এই প্রথমবার তাদের বন্ধুত্বের ভেতরে থাকা “উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত” দেয়ালটা ভেঙে গেলো। মুহূর্তে যেনো সেই বরফ গলতে শুরু করলো।
নিজেদের সামলে নিয়ে তারা বিছানায় বসলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আহিয়া বললো,
“আচ্ছা, তুই ভাইয়াকে কিভাবে চিনলি?”
প্রশ্ন শুনে রিদিতা কাচুমাচু করে কণ্ঠ নামিয়ে বললো,
“সেদিন… তোর ভাইয়ের রুমে আমরা গ্রুপ স্টাডি করছিলাম না? আমি তো জানতাম না, আমি ভুলে তোর রুম ভেবে ঢুকে পড়েছিলাম।”
“সিরিয়াসলি? ভাই কিছু বলে নাই তোকে?”
রিদি ঠোঁট কামড়ে দাঁত বের করে হেসে ফেললো,
“হেহে… কী বলবে? তোর ভাইয়ের কি সেই সাহস আছে, রিদিতা রায়ানকে কিছু বলার?”
আহিয়া হালকা থেমে গেলো। কিছু একটা ভেবে চুপ হয়ে গেলো। রিদিতা হাত নেড়ে তার চিন্তাভাবনা ভাঙলো,
“আচ্ছা বাদ দে এসব, আগে নোটস গুলো দে। সন্ধ্যার আগে আবার বাসায় ফিরতে হবে।”
আহিয়া বই-খাতা ঘাটতে লাগলো। এক হাতে কাগজপত্র বের করতে করতে বললো,
“তুই এই দুইদিন ভার্সিটিতে যাসনি কেনো? আমি তো মেসেজ দিয়েছিলাম, রিপ্লাই করলি না। কাহিনী কী?”
রিদিতা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ঠোঁট চেপে আস্তে বললো,
“কাহিনী কিছু না… শরীর ভালো ছিলো না।”
কিন্তু সত্যিটা বললো না। কীভাবে বলবে, আহাদ রাজার ভয়েই সে টানা দুইদিন ঘর থেকে বের হয়নি? অথচ আজ আবার তার সামনে এসে পড়তে হলো তাও আবার আহাদের বেডরুমে! মাথা ঝাঁকিয়ে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেললো রিদিতা। সে বিছানায় নোটসগুলো ছড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করলো। আহিয়া বললো,
“আমি কফি আনতে যাচ্ছি। তুই থাক।”
আহিয়া বেরিয়ে যেতেই রিদিতার চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিছুক্ষণ আগের দৃশ্য। আহাদের অর্ধনগ্ন শরীর, চকচকে বডি। গাড়ো বাদামি চোখের গভীর দৃষ্টি, ভাবতেই তার গাল জোড়া হঠাৎ লালচে বর্ন ধারন করলো। বুক ধড়ফড় করছে। ইশশ…
রিদি কখনো কল্পনাও করিনি তার ক্রাশকে এত কাছ থেকে… এভাবে দেখতে পাবে!
কলমটা ফেলে দিয়ে দু’হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে ফেললো সে। লজ্জা, ভয় আর আবেগে তার বুকের ভেতর এক অজানা ঢেউ খেলে গেলো।
★
গ্যারেজের পিছনে তৈরি সেই ছোট্ট দুই কামরার ঘরটাই আসলে “ডেমো ঘর” মীর বংশের কাছে এটা এক অদ্ভুত ভ'য়ং'ক'র জায়গা। এখানে কখনো রাজনৈতিক আলাপ হয়, কখনো কারও সাথে বনিবনা না হলে তাকে ডেকে এনে দেখানো হয় আহাদ রাজা মীরের ডেমো। আজ সেই ঘরের মাঝখানে পুরোনো লোহার চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে শামিম পোদ্দার। পুরান ঢাকার নামকরা দালাল। কারওয়ান বাজারের ফুটপাত থেকে শুরু করে পাইকারি সবজির আড়ত পর্যন্ত তার প্রভাব বিস্তার। কিন্তু সমস্যা হলো সে কথা দিয়েও কথা রাখেনি। আহাদের সাথে ডিল হয়েছিলো, সাধারণ ব্যবসায়িদের উপর সে আর জোর খাটাবে না, কিন্তু সুযোগ পেয়ে আবার পুরনো খেলায় ফিরে গেছে। আজ তার সেই ভুলের মাশুল দিতে হবে।
আহাদ রাজা মীর ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। কালো শার্টের দুটো বোতাম খোলা, হাতার মোচড় গোটানো, চোখে ভ'য়ংক'র দৃষ্টি। সে একটা চেয়ার টেনে আনলো, তার উপর এক পা তুলে ঝুঁকে এলো শামিম পোদ্দারের মুখের সামনে। কণ্ঠে কর্কশ গর্জন,
“তোর নাম শামিম পোদ্দার ঠিক আছে… কিন্তু আহাদ রাজার সাথে পোদ্দারি দেখানোটা তোর মোটেও ঠিক হয় নাই।” more....
শামিম পোদ্দারের ঠোঁট কাঁপছে, গলা শুকিয়ে গেছে।
সে তোতলাতে তোতলাতে বললো,
“ভা… ভাই, এবারের মতো মাফ কইরা দেন! জিন্দেগিতে আর ভুল করুম না। কারওয়ান বাজারে আজ থেইক্কা আমাগো ছাঁয়াও দেখবো না কেউ।”
আহাদের ঠোঁটে হালকা এক বাঁকা হাসি ফুটলো।
“আহাদ রাজা মীরের কাছে ভুলের কোনো ক্ষমা নাই পোদ্দার..! তবে তোর কপাল ভালো, আজ আমার মনডা অনেক ফুরফুরে, আমি আজকে মেলা খুশি। তাই তোকে ছোট্ট একটা ডেমো দিয়েই ছেড়ে দিব।”
এ কথা বলে আহাদ গম্ভীর কণ্ঠে ডাক দিলো,
“শাওন… নাদিম!”
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আসফাক মীর, শাহীন, নাদিম আর শাওন। ডাক শুনে শাওন-নাদিম এগিয়ে এলো। আহাদের হালকা ইশারাতেই তারা শামিম পোদ্দারের বাঁধন খুলে দিলো। আহাদ পেছনে হেলান দিয়ে বসলো, চোখ র'ক্তবর্ণ শেয়ালের মতো ঝলসে উঠছে।
“চল, ওই টুলের উপর উঠে দাঁড়া।”
আদেশ শোনার সাথে সাথেই শামিম পোদ্দার ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ গর্জন করে উঠলো আহাদ,
“দুইশো দুইবার কান ধরে উঠবস করবি। একটাও যেনো কম না হয়”
“ভাই, এতোবার করলে আমি মরাই যামু ভাই!”
আহাদ চোখ বড় বড় করে হুংকার ছাড়লো,
“শুরু কর! নাহলে দুইশো থেকে বাড়ায়ে দিবো। কুইক!”
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে শামিম পোদ্দার কান ধরে উঠবস শুরু করলো। এক, দুই, তিন…!
ঘাম ঝরতে শুরু করলো কপাল থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলো। আহাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে হঠাৎ মুখ বাঁকিয়ে বলল, more....
“নাহ… মজা পাচ্ছি না। একটা কাজ কর তোর লুঙ্গিটা খুলে মাথায় তুলে শুরু কর।”
ঘরে থাকা সবাই মুখ টিপে হাসলো। শাওন এগিয়ে এসে তার লুঙ্গি টানতে গেলেই শামিম দুই হাতে শক্ত করে ধরে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
“ভাই! ভাই! আমি লুঙ্গির নিচে জাঙ্গিয়া পরি নাই ভাই!”
“ছেহ! এটা কী করলি? ভাগ্যক্রমে যদি তোর লুঙ্গি দক্ষিণা হাওয়ায় উল্টাইয়া যায়, তাইলে তো তোর পক্ষী সোজা বাজারে নিলামে উঠবো।”
সবাই আবার হেসে উঠলো। শামিম কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “ভাই, পরেরবার আর ভুল করমু না…”
আহাদ হাত নেড়ে বললো,
“ঠিক আছে। এখন কন্টিনিউ কর। তাছাড়া তোর পক্ষী নিলামে উঠলেও কেউ কিনতে চাইবে না।”
কথাটা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লো শাহীন-নাদিমরা। শামিম পোদ্দার আবার কান ধরে উঠবস শুরু করলো। এক সময় শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়লো। তার পা কাঁপছে, শ্বাস ছোট হয়ে আসছে, বুক দিয়ে ঘাম ঝরছে নদীর মতো। অবশেষে ২০২ বার শেষ করে হুঁশ হারাতে হারাতে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়লো। আহাদ ঠাণ্ডা চোখে তাকালো আসফাক মীরের দিকে।
“চাচু, ওই লুঙ্গি নিয়া কি জানো একটা গান আছে না?”
আসফাক মীর গম্ভীর মুখে উত্তর দিলেন,
“হো, লুঙ্গি ড্যান্স।”
আহাদ রাজা হাততালি দিয়ে উঠলো,
“ইয়েস! নাদিম, মিউজিক চালা। এখন পোদ্দার দিবে লুঙ্গি ড্যান্স।”
নাদিম স্পিকারে গান চালালো। ঢোল-ঢাকের তালে তালে বাজতে লাগলো সেই বিখ্যাত সুর। আহাদ পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। শাহীন তার পাশে দাঁড়ালো। শাওন-নাদিম সরে গিয়ে এক পাশে জায়গা করে দিলো। শামিম পোদ্দার কাঁপা ক্লান্ত শরীর নিয়ে আবার দাঁড়ালো। দুই হাতে সাদা লুঙ্গির দুই কোনা ধরলো। অতঃপর সুরের তালে তালে লজ্জায়, ক্লান্তিতে, ভয়ে ভয়ে নাচতে শুরু করলো।
“লুঙ্গি ড্যান্স… লুঙ্গি ড্যান্স..
লুঙ্গি ড্যান্স… লুঙ্গি ড্যান্স…”
সবাই একসাথে হেসে উঠলো। আহাদ রাজা মীর ঠোঁটে ঠাণ্ডা হাসি টেনে কবিতা আবৃতি করলো,
“এই আহাদ রাজা, যখন যাকেই দেয় সাজা।
লুঙ্গি খুলে নাচতে নাচতে বলে, আহা কি মজা কি মজা..!”
ঘরের দেয়ালে ধ্বনিত হলো আহাদের সেই হাসি, সেই গানের আওয়াজ আর শামিম পোদ্দারের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অপমানের অশ্রু more....
No comments: