Header Ads Widget

test

#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী (পর্ব) 8

 


#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী 


আহাদ রাজাকে কাছে আসতে দেখে রিদি চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। হঠাৎ তার শরীর ঢলে পরে যেতে নিলেই আহাদ তাকে নিমিষেই ধরে ফেলে। তবে রিদি আবার নিজেকে সামলে দাঁড়ায়। তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি এমনভাবে চলছে, মনে হলো চারপাশে সবাই শুনতে পাচ্ছে। সেই ধুকপুকানি পৌঁছে গেলো আহাদের কানের গভীর পর্যন্ত। তার দৃষ্টি রিদির কোমল মুখে আটকে গেলো। সে যে ক্রোধ নিয়ে এসেছে, যে আগুন নিয়ে গাড়ি থেকে নেমেছিলো, রিদির মুখ দেখে সেই আগুন মুহূর্তেই বরফ হয়ে গেলো।
রিদির মুখটা লাল হয়ে আছে, কোমল চিকন অধর জোড়া তিরতির করে কাঁপছে। চোখের পাতাগুলো শক্ত করে বন্ধ করা। আহাদ দু হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো সেই মুখের দিকে। তার চোখে অদ্ভুত এক নরম ভাব। সে নিজের ভেতরে এক মুহূর্তে টের পেলো, এই মেয়েটা তার রাগের আগুনকে কীভাবে যেন মুঠির ভেতর বন্দি করে ফেলেছে। এক মূহুর্ত পর আহাদ নরম কণ্ঠে বলল,
“এই আল্লাহর বান্দি এই…! তাকাও আমার দিকে।”
রিদির কোমল শরীর হালকা কেঁপে উঠলো। ভয়ে ভয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুললো, মনে হচ্ছিল যদি সেদিনের মতো আবার থাপ্পড় এসে পড়ে। চোখ খুলতেই সরাসরি দৃষ্টি মেলালো আহাদের গাঢ়ো বাদামি ঘন পাপড়িযুক্ত চোখের সাথে। আর সেই মুহূর্তেই আহাদের মনে হলো, কেউ যেন তার বুক চিরে তীর ছুঁড়ে দিয়েছে। এত ধারালো, এত গভীর সেই দৃষ্টি! সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা তৃষ্ণার্ত ঢোক গিললো। অতঃপর নরম স্বরে প্রশ্ন করলো,
“কি হলো, ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি কি মেরেছি তোমাকে?”
রিদি মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে না সূচক মাথা নাড়লো।
আবারও প্রশ্ন করলো আহাদ,
“বকেছি তোমাকে?”
রিদি এবারও না সূচক মাথা নাড়লো। আহাদ একচিলতে হাসি দিয়ে বললো,
“তাহলে কাঁপছো কেনো?”
“খ… খ.. খুধা লাগছে…!”
রিদি ভয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে হঠাৎ বলে ফেললো কথাটা। তার এই উদ্ভট উত্তর শুনে, আহাদ মুখ লুকিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হালকা হেসে ফেললো। তার রাগ মিশে গেলো নরম স্রোতে। সে দু’আঙুলের পিঠ আলতো করে রিদির কপালে ঠেকিয়ে বললো,
“মাথা গরম হয়ে আছে, বুঝতে পারছি। এমনিই এমনিই তো জুতা ছুড়ে মারোনি।”
রিদি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। নিজের ক্রাস কে জুতা ছুঁড়ে মারা ছি! লজ্জায় আর ভয়ে তার গাল দু'টো লাল বর্ন ধারন করলো। আনিকা আর আহিয়া মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একে অপরের। তাদের মনে হচ্ছে এটা কিভাবে সম্ভব! তারা ভেবেছিলো এখনই বুঝি রিদির গালে ঝড় নামবে, কিন্তু এখানে যেন উল্টোটাই ঘটলো। আহাদ রাজা এত শান্তভাবে কথা বলছে! পাশেই নীলা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ স্থির আহাদের ওপর, ব্যাগের কোনা শক্ত করে চেপে ধরেছে। আহাদ রাজা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রিদিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“চলো।” more...
রিদি ভড়কে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায়…?”
“আইসক্রিম খেতে। আপনার মাথা ঠাণ্ডা করতে হবে তো!”
এই বলে আহাদ হাটা দিলো, কোনো দ্বিধা না করে রিদি ও ধীরে ধীরে পিছু নিলো। তারা গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই
হঠাৎ পিছনে ফিরে তাকিয়ে আহাদ কর্কশ কণ্ঠে বললো,
“কি হলো? তোদের আলাদা করে ইনভাইট করতে হবে?”
তার কথা শুনে আনিকা, আহিয়া আর নীলা আঁতকে উঠে নড়ে চড়ে দাঁড়াল। এরপর সোজা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো সবাই। ভার্সিটির গেট পেরিয়ে কালো গাড়ি গুলো ধীরেধীরে উধাও হয়ে গেলো। আর গেটের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েরা স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেই দৃশ্যের দিকে।
আইসক্রিম পার্লারের ঠাণ্ডা বাতাস থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেই গরম বাতাস ধাক্কা দিয়ে গায়ে লাগলো। রিদিতা একবার চোখ সরু করে তাকালো আহাদের দিকে। কালো চশমা পরা সেই মুখটা রহস্যময় লাগছে। আহাদ রাজা ওয়ালেট বের করে কার্ড রাখলো কাউন্টারে, আবার পকেটে ঢুকিয়ে নিলো নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে। কোনো শব্দ নেই, নেই কোনো রাগের চিহ্ন। এতে রিদিতা একটু বেশিই অবাক হলো।
সে ভেবেছিল আজ আহাদ নিশ্চয়ই তাকে কঠিনভাবে ধমক দেবে, কিংবা কান ধরে উঠবস করাবে। আর তা না হলে একটা থাপ্পড় এসে পরবে তার গালে। কিন্তু আশ্চর্য! এক বিন্দুও রাগ দেখালো না আহাদ। মনে মনে প্রশ্ন ভেসে এলো, তবে কি সত্যিই তার পড়া দোয়াটা কবুল হয়েছে?
মনে হতেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো।
আলতো করে হেসে ফেললো সে একাই। তার সেই উদ্ভট হাসি চোখে পরলো আনিকার। এগিয়ে এসে কানের কাছে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“কিরে, তোর উপর জ্বীন ভর করলো নাকি? একা একা হাসছিস কেনো?”
হাসি মুহূর্তেই উবে গেলো রিদির মুখ থেকে। সে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
“ক..কই হাসলাম!”
“আমারে বোকা বানানো এত সহজ না রিদি। সত্যি করে বল তো! তুই কি আহাদ রাজার প্রেমে পরেছিস?”
রিদির বুক ধপ করে নেমে গেলো। সে তাড়াহুড়ো করে হাত বাড়িয়ে আনিকার মুখ চেপে ধরলো। চোখে চোখ রেখে ইশারা করলো চারপাশে সবাই আছে। আনিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে মুখ সরিয়ে নিলো।
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, রিদি। তুই মানুষ পেলি না, এই নির্দয় লোকটার প্রেমে পড়লি?”
রিদি কেঁপে উঠে ফিসফিস করে বললো,
“চুপ থাক না… প্লিজ।”
দূর থেকে সব লক্ষ্য করছিলো আহাদ। রিদিতাকে হাসপাস করতে দেখে সে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো, হালকা নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, হুম? খারাপ লাগছে? বাসায় যাবে?”
রিদি চোখ নামিয়ে রাখলো। কিছু বলতে যাবে, তবে তার
উত্তর দেবার আগেই আহাদ হাত উঠিয়ে শাহীনকে ডাকলো। তার দায়িত্বে আহিয়াদের রেখে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো রিদিকে সঙ্গে নিয়ে। গাড়ির ভেতরে নিস্তব্ধতা। ঘড়ির কাঁটা আড়াইটা ছুঁই ছুঁই করছে। রাস্তায় হালকা যানজট, কিন্তু গাড়ি চলছে দ্রুত। আহাদের কালো চশমার পেছনে চোখের দৃষ্টি গোপন, কিন্তু তার পাশে বসে থাকা রিদির বুকের ধুকপুকানি গাড়ির ভেতর যেনো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। অবশেষে গাড়ি এসে থামলো রিদির বাসার সামনে। আহাদ দরজা ঠেলে নেমে গেলো। দু’হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়ালো গাড়ির বনেটের পাশে, আধা হেলে থাকা ভঙ্গীতে, যেনো এক অদম্য সম্রাটের মতো। তার দৃষ্টি স্থির রিদির দিকে।
“দেখি হাতটা।”
রিদি হতবাক। মুহূর্তেই হাতটা পিছনে লুকিয়ে ফেললো।আহাদের চোখের মণি মূহুর্তেই জ্বলে উঠলো। রাগী গলায় গর্জে উঠলো আহাদ,
“আমি হাত দিতে বলেছি, কুইক!”
আদেশের সুরে রিদির বুক কেঁপে উঠলো। চারপাশে একবার তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে দিলো হাতটা। তার আঙুলগুলো কাঁপছে, নিঃশ্বাস কেটে কেটে আসছে।
আহাদ বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে হাতটা শক্ত করে ধরলো।
আলতো করে তুলে নিলো কাটা জায়গাটা দেখার জন্য।
তার ভ্রু কুঁচকে গেলো, ঝলসে যাওয়া চোখে রিদির দিকে তাকালো। গলা ভারী করে বললো,
“ঔষধ খাওনি, হাতে ক্রিমও লাগাওনি!”
রিদির গলা শুকিয়ে এলো। ভেতরে ভেতরে ভাবছে সে তো সব ঔষধ ফেলে দিয়েছে। এখন কি বলবে! তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আহাদ আবার গর্জে উঠলো,
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি, রিদি!”
সেই গর্জনে মনে হলো মাটিই কেঁপে উঠলো। সাথে রিদির বুক ধকধক করে কেঁপে উঠলো। সে আর সহ্য করতে পারলো না। একটা দুষ্ট বুদ্ধি খাঁটিয়ে, হঠাৎ সাহস জোগাড় করে আহাদের পিছনের দিকে ইশারা করলো,
“দেখুন, আপনাকে কেউ ডাকছে…”
আহাদ মুহূর্তেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পিছনে। কিন্তু ওখানে কেউ নেই। সেই সুযোগে রিদি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো। এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে ঢুকে গেলো বাসার ভেতর। আহাদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। এরপর বুক ফেটে বেরিয়ে এলো তার আগুন ঝরানো গর্জন,
“রিদি…!!
আই শুয়্যার তোকে আমি বুকের সাথে পিষেই মেরে ফেলবো…!”
সন্ধ্যার আলো তখন অন্ধকারে মিশে আসছে। শহরের হালকা যানজট আর মানুষের কোলাহল মিলিয়ে একটা ভারী ক্লান্তি যেনো বাতাসে ভাসছে। ভারী পদক্ষেপে ভেতরে এলেন আফরোজা শেখ আর পাশে নিস্তব্ধ ভঙ্গীতে হাঁটতে লাগলেন আদনান। দুজনেরই মুখমণ্ডলে ক্লান্তি, অথচ সেই ক্লান্তি ভিন্ন ভিন্ন কারণে।
ড্রইং রুমের সুবিশাল ঝাড়বাতির আলোয় ঘরটা ঝলমল করছে। মখমলের গাঢ় নীল পর্দা টেনে রাখা, কাঁচের জানালায় প্রতিফলিত হচ্ছে ঘরের শোভাবর্ধক সোনালি আলোর ঝিলিক। আফরোজা শেখ ধীরে গিয়ে বসলেন তাঁর নির্দিষ্ট কিং সাইজের আর্মচেয়ারে। ক্লান্ত ভঙ্গীতে গা এলিয়ে দিলেন। এক হাত তুলে মাথার পাশে ঠেস দিলেন।
পাশের সোফায় বসলো আদনান। তার চোখে কোনো বিশেষ আবেগ নেই, একরাশ নির্লিপ্ততা যেনো।
পরিচারিকা রিতু ঠেলে আনলো নাস্তার ট্রলি। দু’জনের সামনেই রেখে দিলো এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি। ঠিক তখনই পাশে এসে বসলেন হালিমা বেগম। শাড়ির আঁচল আলতো করে কাঁধে টেনে নিলেন। একবার তাকালেন আদনানের দিকে, তারপর স্থির দৃষ্টিতে আফরোজা শেখকে দেখে নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“কি হয়েছে আপা? তোমার শরীরটা ঠিক নেই নাকি?”
কথাটা শুনেই যেনো আফরোজা শেখের রাগ আরও বেড়ে গেলো। গ্লাসটা টেবিলে ঠক করে রেখে দিলেন। দু’আঙুল দিয়ে কপাল চেপে ধরে রাগী গলায় বললেন,
“কি হয়েছে সেটা তোমার বড় ছেলেকে জিজ্ঞেস করো হালিমা। যে পাত্রী দেখাতে নিয়ে যাই, সেটাই তার পছন্দ না। উল্টো আলাদা করে পাত্রীর সাথে কথাও বলে না। আমি থাকি একা বোকা হয়ে। আজকালকার যুগে ওর মতের সাথে মানানসই শান্ত, নম্র, ভদ্র মেয়ে কোথায় পাবো! আধুনিকতার ছোঁয়া তো থাকবেই?”
ঘরে নীরবতা নেমে এলো। আদনান ঠাণ্ডা, নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দিলো,
“আমি কখন বলেছি, আমার নম্র, ভদ্র, শান্ত মেয়েই দরকার?”
হালিমা বেগম অবাক হয়ে তাকালেন আদনানের দিকে। এরপর শান্ত স্বরে বললেন,
“তাহলে সমস্যা কোথায় তোমার? কোনো মেয়ে পছন্দ করছো না কেনো? নাকি… আলাদা করে কোন মেয়ে পছন্দ করা আছে? থাকলে বলো, আমরা তার সাথেই তোমার বিয়ে দিবো।”
মুহূর্তেই আদনানের চেহারা পাল্টে গেলো। সে হঠাৎ পিঠ সোজা করে দু’বাহু ঘুরিয়ে নড়েচড়ে বসল। যেনো কিছু বলতে উদ্যত। ঠিক তখনই আফরোজা শেখ ঝাঁজালো কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“তুমিও হালিমা! ওর যদি কোন পছন্দ থাকতো, তাহলে কি আমর সাথে মেয়ে দেখতে যেতো! তাছাড়া আমরা কি জানতাম না এই বিষয়ে! ”
আদনান চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরলো। তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে উঠলো। আফরোজা শেখ আবারও বললেন,
“দেখো আদনান, ভাইজান আর ভাবি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু তুমি যদি এমন করতে থাকো, তাহলে আমার পক্ষে সে দায়িত্ব পালন করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে।
আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, এবার আর তোমার মতামত চাইব না। আমি যা বলবো, সেটাই হবে শেষ সিদ্ধান্ত। মাথায় রেখো।” more...
ঘরে নেমে এলো এক ধরনের বরফ শীতল নীরবতা।আদনান একটাও কথা বললো না। পাশ থেকে নিজের ব্লেজারটা হাতে তুলে নিলো। এরপর গটগট করে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। আফরোজা শেখ চোখ বন্ধ করে আবারও কপালে আঙুল চেপে ধরলেন। মুখে ঝলসে পড়া ক্লান্তি, রাগ আর অসহায়তা মিশ্রিত এক ছাঁপ। হালিমা বেগম সেদিকে তাকিয়ে রইল, ঠিক তখনই আদনান থেমে পিছনে ঘুরলো। দৃষ্টি সরাসরি হালিমার দিকে। গলায় চাপা কিন্তু দৃঢ় সুর,
“চাচি আম্মা, উপরে আমার চা টা পাঠিয়ে দিয়েন।”
বলেই আবার গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।
হালিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কয়েকবার পরিচারিকা রিতুকে ডাকলেন,
“রিতু… রিতু…”
কিন্তু কোনো উত্তর নেই। ঠিক তখনই রান্নাঘরে ঢুকলো আহিয়া। সে দুলতে দুলতে এসে ছোট্ট টেবিলের পাশে চেয়ারে বসল। আলসেমিতে ভরা চোখ, হাতে মোবাইল নিয়ে টুকটাক স্ক্রল করছে। হালিমা বেগম একবার তাকালেন। তারপর আলতো গলায় বললেন,
“আহিয়া মা, আদনানের চা টা একটু দিয়ে আয় না মা।”
আহিয়া অবাক হয়ে চমকে উঠলো।
“কিহহ… আমি? অসম্ভব!”
“কি অসম্ভব? আদনান কি তোকে খেয়ে ফেলবে নাকি?
যা না মা, আমার চুলায় রান্না আছে।”
কোনো উপায় না দেখে আহিয়া গজগজ করতে করতে চায়ের কাপটা তুলে নিলো। ধীরপায়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে উপরে চলে গেলো। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলো আহিয়া। ভেতরটা আধো আলোয় ঢাকা। কোথাও আদনানকে দেখা যাচ্ছে না। একটা ঢোক গিলে সাবধানে ভেতরে পা রাখলো। টেবিলের ওপর কাপটা রাখতে গেলো,
ঠিক তখনই তার চোখ পড়লো বুক সেলফের দিকে।
ভাজ করা বইয়ের ফাঁকে এক ঝলক আলোয় ঝিলিক করছে, একটা অর্ধ-খাওয়া অ্যা'ল'কো'হলের বোতল! আহিয়ার চোখ কপালে উঠে গেলো।
“না… এটা কি ঠিক দেখছি আমি? আদনান ভাই… ড্রিঙ্ক করে?”
যে মানুষ সবসময় শারীরিক সুস্থতা, ফিটনেস, শৃঙ্খলা নিয়ে এত সচেতন, সে কি করে এ রকম করতে পারে!
শিওর হতে আহিয়া দু’পা এগোল সেদিকে। ঠিক তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো আদনান। কাঁধে তোয়ালে, মুখ মুছতে মুছতে হঠাৎ চোখ গেলো আহিয়ার দিকে। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি চাই?”
আহিয়া চমকে উঠলো। কাঁপতে কাঁপতে বললো,
“আ… আপনার চা।”
“রাখ টেবিলে।”
আহিয়া মৃদু শব্দ করে টেবিলে কাপটা রাখলো। দরজার দিকে এগোতেই হঠাৎ থেমে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আদনানের দিকে।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, আদনান ভাই…?”
আদনান একমুহূর্ত স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলো। সে জানে আহিয়া কী জিজ্ঞেস করবে। তাই ঠাণ্ডা, নির্দ্বিধায় উত্তর দিলো,
“না।”
আহিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলো। এক মুহূর্তও আর দাঁড়াল না। তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আদনান বুক সেলফের দিকে বা হাত বাড়িয়ে বইগুলো সরিয়ে আবারও বোতলটাকে আড়াল করলো। এরপর ধপাস করে দেহটা ছুড়ে দিলো বিছানায়। ক্লান্ত চোখে একবার তাকালো টেবিলে রাখা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের দিকে। হঠাৎ তার
ঠোঁটে একটা অদ্ভুত, রহস্যময় মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।
সেই বিকাল থেকেই ঈশানীর পিছনে পিছনে ঘুরছে রিদিতা। কাল রাতে কী সর্বনাশটাই না হলো, ঈশানীর জেরার মুখে আর বেশি নিজেকে সামলাতে পারেনি রিদি। শেষমেশ সব খুলে বলতে হয়েছে, কিভাবে হাত কেটেছে, কী হয়েছে, কেন হয়েছে। শুধু একটা বিষয় খুব সাবধানে এড়িয়ে গেছে, আহাদকে পছন্দ করার কথাটা। সেটা মুখে আনার সাহস হয়নি।
তখন থেকেই ঈশানী মুখ ভার করে আছে। রিদিতার সাথে কথা বলছে না। রিদি কত ডাকাডাকি করলো, টানাটানি করলো কোনো উত্তর নেই। মনে গভীরে অভিমান জমে গেছে। যে বোন বাইরে গিয়ে একটা চকলেট খেলেও এসে ঈশানীকে শেয়ার করতো, ছোটখাটো প্রতিটা সুখ-দুঃখ তার সাথে আলোচনা করতো, সেই বোন এত বড় একটা ঘটনা গোপন করলো! ঈশানীর বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে, তাই সে জেদ ধরে আছে কথাই বলবে না।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। ঘর ভরছে নরম আলোয়। ঈশানী বালিশ পিঠে ঠেকিয়ে চুপচাপ বিছানায় এসে বসল। চোখে মুখে অভিমান জমাট। এদিকে রিদি কেমন অস্থির হয়ে আছে একটু হাসি, একটুখানি কথার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। রিদি এসে বসলো ঈশানীর সামনে। খুনসুটি ভরা ভঙ্গিতে তাকে দুলাতে দুলাতে ডাক দিলো,
“বুবু… এই বুবু… কথা বল না গো।”
ঈশানী ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত স্বরে বলে উঠলো,
“কি হয়েছে সমস্যা কী তোর ? এত জ্বালাচ্ছিস কেন?”
কিন্তু তাতে রিদির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বরং হেসেই দু’আঙুল দিয়ে ঈশানীর ঠোঁটের দুপাশ টিপে ধরে বললো,
“একটু হাসো না গো মাহির মা, ও মাহির মা। ও সুমনের বড় গিন্নী!”
ঈশানীর মুখ একদম গম্ভীর। হাসি তো দূরের কথা, চোখ মুখ আরও কুঁচকে তাকালো রিদির দিকে। রিদি চোখ পিটপিট করলো, ঠোঁট ফুলিয়ে মিষ্টি গলায় বললো,
“এইবার অন্তত একটু হাসো না বুবু।”
কিন্তু কাজ হলো না। তখন রিদি হঠাৎ ঈশানীর নাকটা আঙুল দিয়ে একটু তুলে ধরে বললো,
“জানো তোমারে এখন কার মত লাগে? আমাদের বাড়ির পাশের কাঞ্চন ভাইয়ার যে বোন আছে না, বিনু! একদম তার মত লাগছে।”
এই বলে রিদি নিজেই হেসে কুটিকুটি। কিন্তু এবার ঈশানী ফেটে পড়লো। সে এক ঝটকায় রিদির নরম দু গাল চেপে ধরলো, তাতে তার ঠোঁট জোড়া ফুলে মুখের ভঙ্গি পাল্টে গেছে। ঈশানী হালকা হেসে বললো,
“তুই জানিস, তোকে এখন কেমন দেখতে লাগছে? আমাদের এলাকায় যে গনি খনকার আছে না ? তার ছোট বউয়ের মত লাগছে!”
এই বলে ঈশানী নিজেই হো হো করে হেসে উঠলো। রিদি হা করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে গালে হাত চাপড়ে বললো,
“ছি…! ছি! ছি! ছি..! মোটেও না। আমি কত সুন্দর, মাশাআল্লাহ!”
তার মুখভঙ্গি, হাঁটা-চলা, অভিমান ভরা ভঙ্গি দেখে পাশের ঘর থেকে মাহি এসে উঁকি দিলো। একবার দুই বোন একে অপরের দিকে তাকালো। তার পর মূহুর্তেই অট্ট হাসিতে ফেটে পরলো। এই দৃশ্য দেখে মাহিও আর থাকতে পারলো না, সেও হো হো করে হেসে উঠলো।
রিদির হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেমন জানি শূন্য হয়ে গেলো। বিছানায় চার হাত-পা মেলে দিয়ে শুয়ে আছে সে। সিলিংয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আজকের ঘটনার টুকরো টুকরো অংশগুলো বারবার মাথায় ঘুরে ফিরে আসছে। ঠিক তখনই, টুং!
তার ফোন থেকে ভেসে এলো নোটিফিকেশনের শব্দ।
রিদি চমকে উঠলো। পাশের টেবিলে রাখা ফোনটা টেনে নিলো। স্ক্রিনে চোখ যেতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। আহাদের নামটা ভেশে আছে। হৃদস্পন্দন যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। থরথর কাঁপা আঙুলে স্ক্রিন আনলক করে বার্তাটা পড়তেই তার শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে এলো,
“দুই মিনিটের মধ্যে নিচে আসো, কুইক! দুই মিনিটের মধ্যে যদি না আসো, আমি উপরে উঠে, থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো।”
রিদিতা ধড়ফড় করে উঠে বসল। ফোনটা তার হাত থেকে ছিটকে বিছানায় পড়লো। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ যেন কানে ধাক্কা দিচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে অস্থির ভঙ্গিতে কয়েকবার ঘরের ভেতর পায়চারি করলো। তারপর ধীরে ধীরে ঈশানীর রুমে গিয়ে উকি দিলো। দেখলো ঈশানী মাহিকে পড়াতে ব্যস্ত। দুজনেই বইয়ে ডুবে আছে। রিদির মনে একটু সাহস এলো এখন বের হলে কেউ খেয়ালই করবে না। চুপচাপ ওড়নাটা ভালো করে গলায় আর মাথায় পেঁচিয়ে নিয়ে পা টিপে টিপে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
নিচে এসে দাঁড়াতেই তার চোখ আটকে গেলো, কালো শার্টের হাতা গুটানো, সোজা-সাপ্টা ভঙ্গিতে গাড়ির সাথে হেলে দাঁড়িয়ে আছে আহাদ। কালো চশমায় ঢাকা চোখ, তবুও তার দাপট ভরা উপস্থিতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। গাড়ির হেডলাইটের ম্লান আলোয় তাকে যেন আরও রহস্যময় লাগছে।
রিদির বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগলো। তবুও সে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলো। আহাদ তাকে আসতে দেখে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কালো চশমাটা খুলে পকেটে রাখলো। তার গভীর চোখদুটো রিদির উপর স্থির হলো, পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে একবার অবলোকন করলো। হালকা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজে তার প্রেয়সীকে যেন অসম্ভব মোহনীয় লাগছে। আহাদের চওড়া ঠোঁটে চাপা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। রিদি কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আহাদ হাতঘড়ির উপর তর্জনী আঙুল দিয়ে দু’বার ঠকঠক করে কাঠের মত কঠিন স্বরে বললো,
“এগারো মিনিট লেট! আমি তো বলেছিলাম দুই মিনিটের মধ্যে আসতে।”
রিদি কাচুমাচু মুখে বললো,
“বাসা থেকে বের হতে তো একটু সময় লাগে না কি…”
আহাদের গলা যেন বরফের মত ঠান্ডা, কিন্তু ভেতরে আগুন লুকোনো,
“ না, সময় লাগবে কেনো?”
“ভুল হয়ে গেছে। এরপর থেকে চেষ্টা করবো সময়মতো আসতে।”
আহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ ঠোঁটের কোণে কড়া হাসি টেনে বললো,
“আহাদ রাজার কাছে ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। শাস্তি তো পেতেই হবে।”
রিদির বুক কেঁপে উঠলো। শুকনো ঠোঁট চেটে নিয়ে জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“ক.. কি শাস্তি?”
“যেহেতু এগারো মিনিট লেট, তাই এগারো বার কান ধরে উঠবস করতে হবে।”
রিদির চোখ কপালে, “এহহ… এখন!?”
“হুম, এখনই। শুরু করো। কুইক!”
রিদি ভয়ভয়ে চারপাশে তাকালো। রাতের আবছা অন্ধকার গলি। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। আশেপাশে লোকজন নেই বললেই চলে। বুকের ভেতর একটু সাহস এলো। কিন্তু তার ভাবনা ভেঙে আবার আহাদের কর্কশ কণ্ঠ বাজলো,
“কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ডু ইট!”
রিদি গভীর এক ঢোক গিললো। অতঃপর মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে কান ধরে উঠবস শুরু করলো। এক… দুই… তিন… প্রতি উঠবসের সাথে তার চুল খসে খসে পড়ছিলো গাল ছুঁয়ে। গলার ওড়নাটাও সরে যাচ্ছিলো। লজ্জা, ভয়, রাগ সব মিলেমিশে বুকটা কাঁপছিলো। আর সেই দৃশ্য দেখে আহাদ মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি চেপে ধরলো। কিন্তু ঠোঁটের কোণের টান লুকানো গেলো না। তার ভেতরটা ছটফট করছিলো কেবল একবার তার প্রেয়সীকে এভাবে কাছ থেকে দেখতে। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে হঠাৎই এখানে চলে এসেছে।
রিদি এক এক করে এগারোটা উঠবস শেষ করলো। হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে গেলো। আহাদ কিছুক্ষণ নিরব দাঁড়িয়ে তাকে দেখলো। বুকের ভেতর কেমন ধড়াস করে উঠলো। মনে হলো কেউ বুকের ভেতর ঢাক বাজাচ্ছে। কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বললো,
“হয়েছে। এবার যেতো পারো।”
রিদি বিস্মিত চোখে মাথা তুললো। গলার স্বর হালকা কাঁপছিলো,
“মানে… আপনি কি আমাকে ছয় তলা থেকে নামালেন, শুধু এই কান ধরে উঠবস করানোর জন্য!?”
আহাদের ঠোঁট বাঁকলো। হিমশীতল গলায় বললো, “হ্যাঁ।”
“কেনো?”
“এমনই। আমার ইচ্ছে।”
রিদির চোখ লাল হয়ে উঠলো রাগে। বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে। সে কটমট করে তাকিয়ে রইলো আহাদের দিকে।
আহাদ তা স্পষ্টই বুঝলো। তবুও তার কণ্ঠে অটল দৃঢ়তা,
“যেতে বলেছি তো, যাও এখান থেকে। কুইক।”
রিদি দাঁত কিড়মিড় করতে করতে মনে মনে বললো,
“আরে বজ্জাত বেটা! তোর কপালে আধ পাগল একটা বউ জুটবে, দেখিস।”
এরপর ধাপধাপ করে পা ফেলে ভেতরে ঢুকে গেলো। আহাদ তার চলে যাওয়া পায়ের আওয়াজ শোনলো। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই হো হো করে হেসে উঠলো। সেই হাসিতে যেনো এক অদ্ভুত প্রশান্তি মিশে আছে।more...
“চাচি আম্মা, উপরে আমার চা টা পাঠিয়ে দিয়েন।”
বলেই আবার গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।
হালিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কয়েকবার পরিচারিকা রিতুকে ডাকলেন,
“রিতু… রিতু…”
কিন্তু কোনো উত্তর নেই। ঠিক তখনই রান্নাঘরে ঢুকলো আহিয়া। সে দুলতে দুলতে এসে ছোট্ট টেবিলের পাশে চেয়ারে বসল। আলসেমিতে ভরা চোখ, হাতে মোবাইল নিয়ে টুকটাক স্ক্রল করছে। হালিমা বেগম একবার তাকালেন। তারপর আলতো গলায় বললেন,
“আহিয়া মা, আদনানের চা টা একটু দিয়ে আয় না মা।”
আহিয়া অবাক হয়ে চমকে উঠলো।
“কিহহ… আমি? অসম্ভব!”
“কি অসম্ভব? আদনান কি তোকে খেয়ে ফেলবে নাকি?
যা না মা, আমার চুলায় রান্না আছে।”
কোনো উপায় না দেখে আহিয়া গজগজ করতে করতে চায়ের কাপটা তুলে নিলো। ধীরপায়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে উপরে চলে গেলো। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলো আহিয়া। ভেতরটা আধো আলোয় ঢাকা। কোথাও আদনানকে দেখা যাচ্ছে না। একটা ঢোক গিলে সাবধানে ভেতরে পা রাখলো। টেবিলের ওপর কাপটা রাখতে গেলো,
ঠিক তখনই তার চোখ পড়লো বুক সেলফের দিকে।
ভাজ করা বইয়ের ফাঁকে এক ঝলক আলোয় ঝিলিক করছে, একটা অর্ধ-খাওয়া অ্যা'ল'কো'হলের বোতল! আহিয়ার চোখ কপালে উঠে গেলো।
“না… এটা কি ঠিক দেখছি আমি? আদনান ভাই… ড্রিঙ্ক করে?”
যে মানুষ সবসময় শারীরিক সুস্থতা, ফিটনেস, শৃঙ্খলা নিয়ে এত সচেতন, সে কি করে এ রকম করতে পারে!
শিওর হতে আহিয়া দু’পা এগোল সেদিকে। ঠিক তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো আদনান। কাঁধে তোয়ালে, মুখ মুছতে মুছতে হঠাৎ চোখ গেলো আহিয়ার দিকে। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি চাই?”
আহিয়া চমকে উঠলো। কাঁপতে কাঁপতে বললো,
“আ… আপনার চা।”
“রাখ টেবিলে।”
আহিয়া মৃদু শব্দ করে টেবিলে কাপটা রাখলো। দরজার দিকে এগোতেই হঠাৎ থেমে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আদনানের দিকে।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, আদনান ভাই…?”
আদনান একমুহূর্ত স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলো। সে জানে আহিয়া কী জিজ্ঞেস করবে। তাই ঠাণ্ডা, নির্দ্বিধায় উত্তর দিলো,
“না।”more...
আহিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলো। এক মুহূর্তও আর দাঁড়াল না। তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আদনান বুক সেলফের দিকে বা হাত বাড়িয়ে বইগুলো সরিয়ে আবারও বোতলটাকে আড়াল করলো। এরপর ধপাস করে দেহটা ছুড়ে দিলো বিছানায়। ক্লান্ত চোখে একবার তাকালো টেবিলে রাখা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের দিকে। হঠাৎ তার
ঠোঁটে একটা অদ্ভুত, রহস্যময় মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।
সেই বিকাল থেকেই ঈশানীর পিছনে পিছনে ঘুরছে রিদিতা। কাল রাতে কী সর্বনাশটাই না হলো, ঈশানীর জেরার মুখে আর বেশি নিজেকে সামলাতে পারেনি রিদি। শেষমেশ সব খুলে বলতে হয়েছে, কিভাবে হাত কেটেছে, কী হয়েছে, কেন হয়েছে। শুধু একটা বিষয় খুব সাবধানে এড়িয়ে গেছে, আহাদকে পছন্দ করার কথাটা। সেটা মুখে আনার সাহস হয়নি।
তখন থেকেই ঈশানী মুখ ভার করে আছে। রিদিতার সাথে কথা বলছে না। রিদি কত ডাকাডাকি করলো, টানাটানি করলো কোনো উত্তর নেই। মনে গভীরে অভিমান জমে গেছে। যে বোন বাইরে গিয়ে একটা চকলেট খেলেও এসে ঈশানীকে শেয়ার করতো, ছোটখাটো প্রতিটা সুখ-দুঃখ তার সাথে আলোচনা করতো, সেই বোন এত বড় একটা ঘটনা গোপন করলো! ঈশানীর বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে, তাই সে জেদ ধরে আছে কথাই বলবে না।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। ঘর ভরছে নরম আলোয়। ঈশানী বালিশ পিঠে ঠেকিয়ে চুপচাপ বিছানায় এসে বসল। চোখে মুখে অভিমান জমাট। এদিকে রিদি কেমন অস্থির হয়ে আছে একটু হাসি, একটুখানি কথার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। রিদি এসে বসলো ঈশানীর সামনে। খুনসুটি ভরা ভঙ্গিতে তাকে দুলাতে দুলাতে ডাক দিলো,
“বুবু… এই বুবু… কথা বল না গো।”
ঈশানী ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত স্বরে বলে উঠলো,
“কি হয়েছে সমস্যা কী তোর ? এত জ্বালাচ্ছিস কেন?”
কিন্তু তাতে রিদির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বরং হেসেই দু’আঙুল দিয়ে ঈশানীর ঠোঁটের দুপাশ টিপে ধরে বললো,
“একটু হাসো না গো মাহির মা, ও মাহির মা। ও সুমনের বড় গিন্নী!”
ঈশানীর মুখ একদম গম্ভীর। হাসি তো দূরের কথা, চোখ মুখ আরও কুঁচকে তাকালো রিদির দিকে। রিদি চোখ পিটপিট করলো, ঠোঁট ফুলিয়ে মিষ্টি গলায় বললো,
“এইবার অন্তত একটু হাসো না বুবু।”
কিন্তু কাজ হলো না। তখন রিদি হঠাৎ ঈশানীর নাকটা আঙুল দিয়ে একটু তুলে ধরে বললো,
“জানো তোমারে এখন কার মত লাগে? আমাদের বাড়ির পাশের কাঞ্চন ভাইয়ার যে বোন আছে না, বিনু! একদম তার মত লাগছে।”
এই বলে রিদি নিজেই হেসে কুটিকুটি। কিন্তু এবার ঈশানী ফেটে পড়লো। সে এক ঝটকায় রিদির নরম দু গাল চেপে ধরলো, তাতে তার ঠোঁট জোড়া ফুলে মুখের ভঙ্গি পাল্টে গেছে। ঈশানী হালকা হেসে বললো,
“তুই জানিস, তোকে এখন কেমন দেখতে লাগছে? আমাদের এলাকায় যে গনি খনকার আছে না ? তার ছোট বউয়ের মত লাগছে!”
এই বলে ঈশানী নিজেই হো হো করে হেসে উঠলো। রিদি হা করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে গালে হাত চাপড়ে বললো,
“ছি…! ছি! ছি! ছি..! মোটেও না। আমি কত সুন্দর, মাশাআল্লাহ!”
তার মুখভঙ্গি, হাঁটা-চলা, অভিমান ভরা ভঙ্গি দেখে পাশের ঘর থেকে মাহি এসে উঁকি দিলো। একবার দুই বোন একে অপরের দিকে তাকালো। তার পর মূহুর্তেই অট্ট হাসিতে ফেটে পরলো। এই দৃশ্য দেখে মাহিও আর থাকতে পারলো না, সেও হো হো করে হেসে উঠলো।
রিদির হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেমন জানি শূন্য হয়ে গেলো। বিছানায় চার হাত-পা মেলে দিয়ে শুয়ে আছে সে। সিলিংয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আজকের ঘটনার টুকরো টুকরো অংশগুলো বারবার মাথায় ঘুরে ফিরে আসছে। ঠিক তখনই, টুং!
তার ফোন থেকে ভেসে এলো নোটিফিকেশনের শব্দ।
রিদি চমকে উঠলো। পাশের টেবিলে রাখা ফোনটা টেনে নিলো। স্ক্রিনে চোখ যেতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। আহাদের নামটা ভেশে আছে। হৃদস্পন্দন যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। থরথর কাঁপা আঙুলে স্ক্রিন আনলক করে বার্তাটা পড়তেই তার শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে এলো,
“দুই মিনিটের মধ্যে নিচে আসো, কুইক! দুই মিনিটের মধ্যে যদি না আসো, আমি উপরে উঠে, থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো।”
রিদিতা ধড়ফড় করে উঠে বসল। ফোনটা তার হাত থেকে ছিটকে বিছানায় পড়লো। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ যেন কানে ধাক্কা দিচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে অস্থির ভঙ্গিতে কয়েকবার ঘরের ভেতর পায়চারি করলো। তারপর ধীরে ধীরে ঈশানীর রুমে গিয়ে উকি দিলো। দেখলো ঈশানী মাহিকে পড়াতে ব্যস্ত। দুজনেই বইয়ে ডুবে আছে। রিদির মনে একটু সাহস এলো এখন বের হলে কেউ খেয়ালই করবে না। চুপচাপ ওড়নাটা ভালো করে গলায় আর মাথায় পেঁচিয়ে নিয়ে পা টিপে টিপে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
নিচে এসে দাঁড়াতেই তার চোখ আটকে গেলো, কালো শার্টের হাতা গুটানো, সোজা-সাপ্টা ভঙ্গিতে গাড়ির সাথে হেলে দাঁড়িয়ে আছে আহাদ। কালো চশমায় ঢাকা চোখ, তবুও তার দাপট ভরা উপস্থিতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। গাড়ির হেডলাইটের ম্লান আলোয় তাকে যেন আরও রহস্যময় লাগছে।
রিদির বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগলো। তবুও সে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলো। আহাদ তাকে আসতে দেখে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কালো চশমাটা খুলে পকেটে রাখলো। তার গভীর চোখদুটো রিদির উপর স্থির হলো, পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে একবার অবলোকন করলো। হালকা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজে তার প্রেয়সীকে যেন অসম্ভব মোহনীয় লাগছে। আহাদের চওড়া ঠোঁটে চাপা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। রিদি কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আহাদ হাতঘড়ির উপর তর্জনী আঙুল দিয়ে দু’বার ঠকঠক করে কাঠের মত কঠিন স্বরে বললো, more...
“এগারো মিনিট লেট! আমি তো বলেছিলাম দুই মিনিটের মধ্যে আসতে।”
রিদি কাচুমাচু মুখে বললো,
“বাসা থেকে বের হতে তো একটু সময় লাগে না কি…”
আহাদের গলা যেন বরফের মত ঠান্ডা, কিন্তু ভেতরে আগুন লুকোনো,
“ না, সময় লাগবে কেনো?”
“ভুল হয়ে গেছে। এরপর থেকে চেষ্টা করবো সময়মতো আসতে।”
আহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ ঠোঁটের কোণে কড়া হাসি টেনে বললো,
“আহাদ রাজার কাছে ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। শাস্তি তো পেতেই হবে।”
রিদির বুক কেঁপে উঠলো। শুকনো ঠোঁট চেটে নিয়ে জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“ক.. কি শাস্তি?”
“যেহেতু এগারো মিনিট লেট, তাই এগারো বার কান ধরে উঠবস করতে হবে।”
রিদির চোখ কপালে, “এহহ… এখন!?”
“হুম, এখনই। শুরু করো। কুইক!”
রিদি ভয়ভয়ে চারপাশে তাকালো। রাতের আবছা অন্ধকার গলি। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। আশেপাশে লোকজন নেই বললেই চলে। বুকের ভেতর একটু সাহস এলো। কিন্তু তার ভাবনা ভেঙে আবার আহাদের কর্কশ কণ্ঠ বাজলো,
“কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ডু ইট!”
রিদি গভীর এক ঢোক গিললো। অতঃপর মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে কান ধরে উঠবস শুরু করলো। এক… দুই… তিন… প্রতি উঠবসের সাথে তার চুল খসে খসে পড়ছিলো গাল ছুঁয়ে। গলার ওড়নাটাও সরে যাচ্ছিলো। লজ্জা, ভয়, রাগ সব মিলেমিশে বুকটা কাঁপছিলো। আর সেই দৃশ্য দেখে আহাদ মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি চেপে ধরলো। কিন্তু ঠোঁটের কোণের টান লুকানো গেলো না। তার ভেতরটা ছটফট করছিলো কেবল একবার তার প্রেয়সীকে এভাবে কাছ থেকে দেখতে। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে হঠাৎই এখানে চলে এসেছে।
রিদি এক এক করে এগারোটা উঠবস শেষ করলো। হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে গেলো। আহাদ কিছুক্ষণ নিরব দাঁড়িয়ে তাকে দেখলো। বুকের ভেতর কেমন ধড়াস করে উঠলো। মনে হলো কেউ বুকের ভেতর ঢাক বাজাচ্ছে। কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বললো,
“হয়েছে। এবার যেতো পারো।”
রিদি বিস্মিত চোখে মাথা তুললো। গলার স্বর হালকা কাঁপছিলো,
“মানে… আপনি কি আমাকে ছয় তলা থেকে নামালেন, শুধু এই কান ধরে উঠবস করানোর জন্য!?”
আহাদের ঠোঁট বাঁকলো। হিমশীতল গলায় বললো, “হ্যাঁ।”
“কেনো?”
“এমনই। আমার ইচ্ছে।”
রিদির চোখ লাল হয়ে উঠলো রাগে। বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে। সে কটমট করে তাকিয়ে রইলো আহাদের দিকে।
আহাদ তা স্পষ্টই বুঝলো। তবুও তার কণ্ঠে অটল দৃঢ়তা,
“যেতে বলেছি তো, যাও এখান থেকে। কুইক।”
রিদি দাঁত কিড়মিড় করতে করতে মনে মনে বললো,
“আরে বজ্জাত বেটা! তোর কপালে আধ পাগল একটা বউ জুটবে, দেখিস।”
এরপর ধাপধাপ করে পা ফেলে ভেতরে ঢুকে গেলো। আহাদ তার চলে যাওয়া পায়ের আওয়াজ শোনলো। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই হো হো করে হেসে উঠলো। সেই হাসিতে যেনো এক অদ্ভুত প্রশান্তি মিশে আছে। more...
এই বলে ঈশানী নিজেই হো হো করে হেসে উঠলো। রিদি হা করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে গালে হাত চাপড়ে বললো,
“ছি…! ছি! ছি! ছি..! মোটেও না। আমি কত সুন্দর, মাশাআল্লাহ!”
তার মুখভঙ্গি, হাঁটা-চলা, অভিমান ভরা ভঙ্গি দেখে পাশের ঘর থেকে মাহি এসে উঁকি দিলো। একবার দুই বোন একে অপরের দিকে তাকালো। তার পর মূহুর্তেই অট্ট হাসিতে ফেটে পরলো। এই দৃশ্য দেখে মাহিও আর থাকতে পারলো না, সেও হো হো করে হেসে উঠলো।
রিদির হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেমন জানি শূন্য হয়ে গেলো। বিছানায় চার হাত-পা মেলে দিয়ে শুয়ে আছে সে। সিলিংয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আজকের ঘটনার টুকরো টুকরো অংশগুলো বারবার মাথায় ঘুরে ফিরে আসছে। ঠিক তখনই, টুং!
তার ফোন থেকে ভেসে এলো নোটিফিকেশনের শব্দ।
রিদি চমকে উঠলো। পাশের টেবিলে রাখা ফোনটা টেনে নিলো। স্ক্রিনে চোখ যেতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। আহাদের নামটা ভেশে আছে। হৃদস্পন্দন যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। থরথর কাঁপা আঙুলে স্ক্রিন আনলক করে বার্তাটা পড়তেই তার শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে এলো,
“দুই মিনিটের মধ্যে নিচে আসো, কুইক! দুই মিনিটের মধ্যে যদি না আসো, আমি উপরে উঠে, থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো।”
রিদিতা ধড়ফড় করে উঠে বসল। ফোনটা তার হাত থেকে ছিটকে বিছানায় পড়লো। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ যেন কানে ধাক্কা দিচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে অস্থির ভঙ্গিতে কয়েকবার ঘরের ভেতর পায়চারি করলো। তারপর ধীরে ধীরে ঈশানীর রুমে গিয়ে উকি দিলো। দেখলো ঈশানী মাহিকে পড়াতে ব্যস্ত। দুজনেই বইয়ে ডুবে আছে। রিদির মনে একটু সাহস এলো এখন বের হলে কেউ খেয়ালই করবে না। চুপচাপ ওড়নাটা ভালো করে গলায় আর মাথায় পেঁচিয়ে নিয়ে পা টিপে টিপে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
নিচে এসে দাঁড়াতেই তার চোখ আটকে গেলো, কালো শার্টের হাতা গুটানো, সোজা-সাপ্টা ভঙ্গিতে গাড়ির সাথে হেলে দাঁড়িয়ে আছে আহাদ। কালো চশমায় ঢাকা চোখ, তবুও তার দাপট ভরা উপস্থিতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। গাড়ির হেডলাইটের ম্লান আলোয় তাকে যেন আরও রহস্যময় লাগছে।
রিদির বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগলো। তবুও সে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলো। আহাদ তাকে আসতে দেখে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কালো চশমাটা খুলে পকেটে রাখলো। তার গভীর চোখদুটো রিদির উপর স্থির হলো, পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে একবার অবলোকন করলো। হালকা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজে তার প্রেয়সীকে যেন অসম্ভব মোহনীয় লাগছে। আহাদের চওড়া ঠোঁটে চাপা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। রিদি কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আহাদ হাতঘড়ির উপর তর্জনী আঙুল দিয়ে দু’বার ঠকঠক করে কাঠের মত কঠিন স্বরে বললো, more...
“এগারো মিনিট লেট! আমি তো বলেছিলাম দুই মিনিটের মধ্যে আসতে।”
রিদি কাচুমাচু মুখে বললো,
“বাসা থেকে বের হতে তো একটু সময় লাগে না কি…”
আহাদের গলা যেন বরফের মত ঠান্ডা, কিন্তু ভেতরে আগুন লুকোনো,
“ না, সময় লাগবে কেনো?”
“ভুল হয়ে গেছে। এরপর থেকে চেষ্টা করবো সময়মতো আসতে।”
আহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ ঠোঁটের কোণে কড়া হাসি টেনে বললো,
“আহাদ রাজার কাছে ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। শাস্তি তো পেতেই হবে।”
রিদির বুক কেঁপে উঠলো। শুকনো ঠোঁট চেটে নিয়ে জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“ক.. কি শাস্তি?”
“যেহেতু এগারো মিনিট লেট, তাই এগারো বার কান ধরে উঠবস করতে হবে।”
রিদির চোখ কপালে, “এহহ… এখন!?”
“হুম, এখনই। শুরু করো। কুইক!”
রিদি ভয়ভয়ে চারপাশে তাকালো। রাতের আবছা অন্ধকার গলি। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। আশেপাশে লোকজন নেই বললেই চলে। বুকের ভেতর একটু সাহস এলো। কিন্তু তার ভাবনা ভেঙে আবার আহাদের কর্কশ কণ্ঠ বাজলো,
“কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ডু ইট!”
রিদি গভীর এক ঢোক গিললো। অতঃপর মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে কান ধরে উঠবস শুরু করলো। এক… দুই… তিন… প্রতি উঠবসের সাথে তার চুল খসে খসে পড়ছিলো গাল ছুঁয়ে। গলার ওড়নাটাও সরে যাচ্ছিলো। লজ্জা, ভয়, রাগ সব মিলেমিশে বুকটা কাঁপছিলো। আর সেই দৃশ্য দেখে আহাদ মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি চেপে ধরলো। কিন্তু ঠোঁটের কোণের টান লুকানো গেলো না। তার ভেতরটা ছটফট করছিলো কেবল একবার তার প্রেয়সীকে এভাবে কাছ থেকে দেখতে। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে হঠাৎই এখানে চলে এসেছে।
রিদি এক এক করে এগারোটা উঠবস শেষ করলো। হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে গেলো। আহাদ কিছুক্ষণ নিরব দাঁড়িয়ে তাকে দেখলো। বুকের ভেতর কেমন ধড়াস করে উঠলো। মনে হলো কেউ বুকের ভেতর ঢাক বাজাচ্ছে। কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বললো,
“হয়েছে। এবার যেতো পারো।”
রিদি বিস্মিত চোখে মাথা তুললো। গলার স্বর হালকা কাঁপছিলো,
“মানে… আপনি কি আমাকে ছয় তলা থেকে নামালেন, শুধু এই কান ধরে উঠবস করানোর জন্য!?”
আহাদের ঠোঁট বাঁকলো। হিমশীতল গলায় বললো, “হ্যাঁ।”
“কেনো?”
“এমনই। আমার ইচ্ছে।”
রিদির চোখ লাল হয়ে উঠলো রাগে। বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে। সে কটমট করে তাকিয়ে রইলো আহাদের দিকে।
আহাদ তা স্পষ্টই বুঝলো। তবুও তার কণ্ঠে অটল দৃঢ়তা,
“যেতে বলেছি তো, যাও এখান থেকে। কুইক।”
রিদি দাঁত কিড়মিড় করতে করতে মনে মনে বললো,
“আরে বজ্জাত বেটা! তোর কপালে আধ পাগল একটা বউ জুটবে, দেখিস।”
এরপর ধাপধাপ করে পা ফেলে ভেতরে ঢুকে গেলো। আহাদ তার চলে যাওয়া পায়ের আওয়াজ শোনলো। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই হো হো করে হেসে উঠলো। সেই হাসিতে যেনো এক অদ্ভুত প্রশান্তি মিশে আছে। more...

No comments:

720

Powered by Blogger.