#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী
রাত তখন প্রায় এগারোটা। চারদিক নিস্তব্ধ, শহরের কোলাহল ধীরে ধীরে থেমে এসেছে। একেকটা গাড়ির হর্ন বা দূরের কুকুরের ডাক যেন অন্ধকারে ভেসে আসা একেকটা শব্দমাত্র। এই সময়েই ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো আহাদ রাজা। হলঘরে ঢুকতেই তার জুতার শব্দ প্রতিধ্বনি তুললো চারদিকে। সেই শব্দ শুনে ছুটে এলো তার দুই প্রিয় সঙ্গী, সিরিয়াস আর কোকো। দুই পোষা কুকুর লাফিয়ে লাফিয়ে আহাদকে ঘিরে ধরলো, যেন সারাদিনের অপেক্ষার পর প্রিয় মানুষটাকে পেয়ে আনন্দে উন্মাদ হয়ে গেছে।
আহাদ তাদের দু’জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ক্লান্তি সত্ত্বেও ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠলো। একটা লাল বল তুলে নিয়ে খেলা শুরু করলো। একবার ছুড়ে মারে, আর তারা হুড়মুড় করে দৌড়ে গিয়ে সেটা আবার তুলে এনে দেয় তার হাতে। ঠিক তখনই তার চোখ গেলো ডান পাশের লাইব্রেরি কর্নারের দিকে। সেখানকার উষ্ণ আলোয় টেবিলে বসে আছেন তার বাবা আমজাদ মীর আর চাচা আসফাক মীর। দুজনেই ডুবে আছেন কোনো গুরুত্বপূর্ন আলোচনায়। টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র, খোলা ফাইল আর ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ।
আহাদ কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর এক নিঃশ্বাসে হাতে থাকা বলটা দূরে ছুড়ে মারলো। সিরিয়াস আর কোকো ছুটে গেলো সেদিকে। আহাদ ভারী শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো চাচার পাশে সোফায়। ধপ শব্দে দুই ভাই তাকালো তার দিকে। আসফাক মীর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় ছিলি তুই? সংসদের সভার পর থেকে তো হাওয়া হয়ে গেছিস।”
আমজাদ মীর তখন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চশমাটা নাকে ঠেলে দিলেন। তারপর ব্যঙ্গের সুরে বললেন,
“কোথায় যাবে আর? গেছে নিশ্চয়ই কোনো… প্রেয়সীর খোঁজে।”
আহাদ এক মুহূর্ত বাবার দিকে আড় চোখে তাকালো। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে সোজা উত্তর দিলো,
“খুঁজতে না, দেখতে গিয়েছিলাম।”
“তার মানে খুঁজে পেয়েছো তাকে।”
“হুম।”
এই উত্তরে আসফাক মীরের চোখ কপালে। বিস্ময়ে বলে উঠলো,
“এক মিনিট, এক মিনিট… কিসের প্রেয়সী!? কোন প্রেয়সী?”
আহাদ এবার চোখ বন্ধ করে হালকা মুচকি হাসলো। আস্তে আস্তে উচ্চারণ করলো,
“লাল শাড়ির প্রেয়সী।”
এক মুহূর্তের জন্য যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো সব কিছু। শুধু টেবিল ল্যাম্পের হালকা আলোয় আহাদের মুখে ঝিলিক ছড়াচ্ছে। আসফাক মীরের মুখে বিস্ময়ের ছাঁপ স্পষ্ট।
“তুই প্রেমে পড়েছিস, আহাদ!?”
আহাদ চোখ খুলে চাচার দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে যেন এক অদ্ভুত গভীরতা। চাচার মনে আর কোনো সন্দেহ রইলো না।
“সিরিয়াসলি! আহাদ রাজা প্রেমে পড়েছে? বিষয়টা কেমন অদ্ভুত না!”
আহাদ আবার চোখ বন্ধ করে মাথাটা সোফার পেছনে এলিয়ে দিলো। অতঃপর গভীর এক নিশ্বাস ফেললো। তার কণ্ঠ ভেসে এলো নিস্তব্ধতায়,
“অদ্ভুত তো বটেই, চাচু।”
“ভালোবাসা… ব্যাপারটাই তো এক রহস্যময় মায়াজাল।
উনিশ কোটি সত্তর লাখ বর্গমাইলের বিশাল পৃথিবী,
আটশো কোটি মানুষের ভিড়। তবুও প্রেম এসে থেমে যায় কেবল একজনের দোরগোড়ায়। অদ্ভুত না?
একজন মানুষ, যার দিকে তাকালেই মনে হয়, এই পৃথিবীর সমস্ত শব্দ থেমে গেছে, বাকি সবাই ধোঁয়ায় ঢাকা।
তার জন্যই বুকের গভীরে এক অদ্ভুত টান জন্ম নেয়।
যে টান কোনো যুক্তি মানে না, কোনো ব্যাখ্যা চায় না।
তাকে ছাড়া সবকিছুই অসম্পূর্ণ।
শব্দগুলো নিস্তব্ধ, আলো নিঃশেষ।
শুধু সেই এক মানুষই হয়ে ওঠে সমগ্র পৃথিবীর মানে।
ভেবে দেখো, এর চেয়ে কি অদ্ভুত আর কিছু হতে পারে?” more...
শেষের লাইনটা বলার সময় আহাদের চোখ স্থির হলো আসফাক মীরের দিকে। দুই ভাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। মুখ প্রসারিত হয়ে হা হয়ে গেছে অবিশ্বাসে। আহাদ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে, হঠাৎ দু’হাতে বাড়িয়ে দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দিলো। আবার হেলান দিয়ে বসল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবারও দুই ভাইয়ের মুখ হাঁ হয়ে গেলো। আহাদ এবার বিরক্ত হয়ে গর্জে উঠলো,
“সমস্যা কি তোমাদের? এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? এমনভাবে তাকাচ্ছো যেন আমি অপরাধ করে ফেলেছি!”
আসফাক মীর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললো,
“ভাইজান, কোনভাবে কি আমাদের আহাদ কারো সাথে অদলবদল হয়ে গেছে?”
এই কথা শুনেই আহাদের মাথায় রাগ চড়ে গেলো। তার গলার স্বর রুক্ষ হয়ে উঠলো,
“বাহ! কি ভাগ্য করে পরিবার পেয়েছি আমি! কোথায় আমাকে অভিনন্দন জানাবে, তা না করে উল্টো বোয়াল মাছের মত হা করে, বএিশটা পাটি বের করে বসে আছে। চমৎকার!”
একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুজনেই তাড়াহুড়ো করে মুখ বন্ধ করলো। আহাদ গর্জে উঠে দাঁড়ালো। কড়া দৃষ্টিতে একবার তাকালো বাবা আর চাচার দিকে। তারপর গটগট শব্দ তুলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। সে চলে যেতেই দুই ভাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে হঠাৎই হো হো করে হেসে উঠলো।
আহাদ নিজের রুমে ঢুকে জুতোজোড়া খুলে এক কোণে ছুড়ে মারলো। শরীরের ভেতর জমে থাকা রাগটা যেন জুতোর সাথে গিয়েই দেয়ালে আঘাত করলো। বিছানায় এসে এলিয়ে পড়লো। ক্লান্ত শরীরটা গভীরভাবে ডুবে গেলো নরম গদিতে। তার চোখ গিয়ে থামলো আলমারির দিকে। সেখানে রাখা আছে তার প্রেয়সীর লাল শাড়িটা। মুহূর্তেই আহাদের বুকের ভেতর অন্যরকম কাঁপুনি বয়ে গেলো। যেন হাজার ঝড়ের মাঝেও এই একটুকরো কাপড় তার শান্তির আশ্রয়।
সে চোখ বন্ধ করলো। অচেতনভাবে হাত ছুঁয়ে দিলো বুকে। শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে এলো। এক অজানা অনুভূতির ঢেউ তাকে গ্রাস করে নিলো। ধীরে ধীরে সে তলিয়ে গেলো গভীর স্বপ্নরাজ্যে, যেখানে আছে শুধু সেই এক মানুষ, লাল শাড়ির প্রেয়সী।
ভার্সিটির বিশাল গেটটা পেরিয়ে রিদিতা হালকা ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকলো। সকালের রোদটা গা এলিয়ে দিয়েছে, তার কালো মনির চোখজোড়া একটু আধা-ঘুমে ভারী হলেও মুখে টুকটুকে ফ্রেশ লুক। পায়ের ধূলা যেনও প্রতিটি পদক্ষেপে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। তার দুই পাশেই আনিকা আর নীলা হাঁটছে, তিনজনের হাঁটার ছন্দ মিলেমিশে যেনো কোনো সুর তুলছে। একটু চুপচাপ এগিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ নীরবতা ভেঙে রিদি নীলার দিকে ঘুরে বলে,
“কিরে, আহিয়া আসলো না কেন? সকালেও তো বলছিলো আসবে।”
নীলা ব্যাগটা কাঁধ থেকে একটু সরিয়ে নিয়ে উত্তর দিলো,
“ওর নাকি শরীর ভালো না, তাই আসে নাই।”
আনিকা ঠোঁট বেঁকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠলো,
“ভালই করেছে আসে নাই। এই বয়সেও বসে বসে স্যারদের লেকচার শুনতে কারো ভালো লাগে নাকি?”
নীলা খোঁচা মারার ভঙ্গিতে বললো,
“তাহলে তো তোরে জন্মের পরই ভার্সিটিতে ভর্তি করানো উচিত ছিলো! তখন লেকচার শুনতে মজা লাগতো নিশ্চয়ই।”
নীলার এই কথায় হো হো করে হাসি ছুটলো রিদির মুখে। এত জোরে হাসলো যে সামলে উঠতে না পেরে প্রায় নুয়ে পড়লো। তার হাসিতে আশেপাশের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীও তাকিয়ে দেখলো। কিন্তু আনিকা ভীষণ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“ভাই! বুড়া হয়ে যাচ্ছি। কবে আমার বিয়ে হবে, কবে তিনটা বাচ্চা হবে আর কবে ওদের নিয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করবো! ভাব তো, বাচ্চাদের ক্লাসে বসে থাকার বয়সে এখন নিজের ক্লাসে বসতে হচ্ছে। দূর… আমার দিন দুনিয়ার কিছু আর ভালো লাগছে না!”
তার এই নাটকীয় ঘোষণায় রিদি আর নীলা চোখাচোখি করলো। তারা দুজনই জানতো, আনিকার কথা শেষ মেশ এখানে এসেই থামবে। বিয়ে, বাচ্চা আর সংসারের দুঃখের কথা। দুজনেই আর নিজেদের ধরে রাখতে পারলো না, হো হো করে হেসে উঠলো। ঠিক তখনই পিছন থেকে এক পরিচিত ডাক ভেসে এলো,
“রিদিতা..!”more...
হঠাৎ করে তিনজনেরই হাসি থেমে গেলো। তারা ঘুরে তাকালো। দূর থেকে দৌড়ে আসছে তাদেরই সহপাঠী তামিম। শার্টের বোতামগুলো আধখোলা, চুলগুলো এলোমেলো, ফর্শা মুখে ঘামে চকচক করছে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়াল, বুকটা উঁচু নিচু করছে তীব্র শ্বাসে।
“রিদি..!”
রিদি অবাক হয়ে বলে উঠলো, “তামিমি! তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছো কেনো?
তামিম কপালের ঘাম হাতের তালু দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,
“কতবার ডেকেছি তোমাকে, কিন্তু শুনতেই পাওনি।”
রিদি একটু লজ্জিত হাসি দিয়ে মাথা চুলকে উত্তর দিলো,
“আসলে ওদের সাথে গল্পে মশগুল ছিলাম তো…”
আনিকা হাত কোমরে দিয়ে তামিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ডাকছিলে কেনো সেটা বলো।”
তামিম একটু ইতস্তত করে রিদির চোখের দিকেই তাকিয়ে বললো,
“আসলে… আমি তো কাল ক্লাসে আসিনি। তাই ভাবছিলাম, তোমার নোটসগুলো যদি একটু পাই?”
আনিকা ভুরু কুঁচকে সঙ্গে সঙ্গে বললো,
“আমাদের কাছে ও তো চাইতে পারো, ওর কাছ থেকেই কেনো নিতে হবে?”
“তোমাদের লেখা আমি বুঝি না। মনে হয় প্রেসক্রিপশন লিখে দাও, একেকজন পিএইচডি ডাক্তার!”
এই কথা শুনে রিদি হো হো করে হেসে ফেললো। তারপর আবার মাথা চুলকে বললো,
“হে হে… আমার নিজের লেখাও তো আমি নিজেই বুঝতে পারি না, তুমি কি করে বুঝবে?”
তামিম নির্ভার কণ্ঠে বললো,
“তোমার টা আমি বুঝবো। তুমি দাও তো।”
কোনো কথা না বাড়িয়ে রিদি ব্যাগের চেইন খুলে ভেতর থেকে নোটসগুলো বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিলো। নোটস হাতে নিয়ে তামিমের চোখে যেন অদ্ভুত একটা উজ্জ্বলতা জ্বলে উঠলো। তারপর তিনজনই আবার সামনে হেঁটে যেতে লাগলো। আর পিছনে দাঁড়িয়ে তামিম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রিদির চলার ভঙ্গির দিকে। রিদি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে যদি তাকায় তার দিকে, এই আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু তামিমকে নিরাশ করে চলে গেলো রিদি। তবুও তামিম হালকা একটা হাসি ফেলে মনের ভেতর ফিসফিস করে বললো,
"অদ্ভুত মেয়ে… শুধু একবার তাকিয়ে দেখলে কি এমন হতো!”
★
ক্লাসের মাঝের সারির সিটে এসে বসেছে রিদি, আনিকা আর নীলা। সামনে বোর্ডে লেখা সমীকরণগুলো ঝকঝক করছে। এখন পদার্থবিজ্ঞানের গুরুতপূর্ন ক্লাস হবে। স্যার কলম হাতে নিয়ে বোর্ডে সমীকরণ টেনে লিখছেন, গলা পরিষ্কার করে লেকচার শুরু করলেন। চারদিকে নিস্তব্ধতা, শুধু স্যারের কণ্ঠ আর দাগ টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঠিক তখনই হঠাৎ করেই ক্লাসের দরজা দিয়ে একেবারে হুড়মুড় করে ঢুকলো আহাদ রাজার তিন পান্ডা শাহীন, নাদিম আর শাওন। more...
ক্লাসে এক অস্বস্তিকর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো। সবাই হঠাৎ পিছনে ঘুরে তাকালো। তাদের দেখামাত্রই রিদির বুক ধক করে উঠলো। মাথার ভেতর ঝড় বয়ে যেতে লাগলো, না জানি আবার কী কান্ড করে বসে এরা…
তিনজন কারো তোয়াক্কা না করেই সোজা এসে দাঁড়ালো রিদির সামনে। স্যারের লেকচার থেমে গেলো, হাত মাঝ পথে ঝুলে রইলো। এক মুহূর্তের জন্য ক্লাসরুমের বাতাস জমাট বেঁধে গেলো। শাহীন এগিয়ে এসে রিদির সামনে কয়েকটা প্যাকেট এগিয়ে ধরলো। কণ্ঠ ভারি করে বললো,
“এগুলো ভাই পাঠিয়েছে, আপনার জন্য।”
রিদি চারপাশে তাকালো। প্রায় পুরো ক্লাসের চোখ আটকে আছে তার দিকে। বুকের ভেতরটা ধকধক করছে। সে কপালে হাত রেখে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করলো। কিন্তু আনিকা এবার খেঁকিয়ে উঠলো,
“কী আছে এতে!?”
শাহীন আনিকার দিকে বিরক্ত চোখে তাকালো। এরপর ঠান্ডা গলায় বললো,
“খাবার আছে। উনি সকালে খেয়ে আসেননি, তাই ভাই খাবার পাঠিয়েছে। বলেছে এখনই যেন খেয়ে নেয়।”
আনিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো,
“এগুলো আপনারা তিন পান্ডা মিলে খেয়ে নিন। এখন আমাদের ক্লাস চলছে, দেখতে পাচ্ছেন না নাকি?”
শাহীন ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো,
“আপনি এত হাইপার হচ্ছেন কেনো? আপনাকে তো কিছু বলা হচ্ছে না।”
তারপর আবার প্যাকেটগুলো রিদির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এতে ভাইয়ের একটা চিরকুটও আছে।”
রিদির শরীর যেন জমে গেলো। হাতের তালু ঘামে ভিজে গেছে। শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেট নিলো। ভেতর থেকে কাগজের টুকরো বের করলো। তাতে স্পষ্ট লেখা,
“এখনই খাবার না খেলে তোমার সাথে কী হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই তুমি ভালো করেই জানো, মিস জা..নু!”
চিরকুট পড়তেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। কাগজটা মুড়িয়ে নিলো মুঠোতে। ধীরে চোখ তুলতেই দেখলো, সামনে দাঁড়িয়ে স্যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সেই চোখের ভার সইতে না পেরে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ক্লাস থেকে এক দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। তার পিছনেই ছুটলো আনিকা আর নীলা। বেরোনোর আগে আনিকা শাহীনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইচ্ছে করেই তার পায়ে জোরে একটা পারা দিলো। শাহীন দাঁত চেপে মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো ব্যথায়, কিন্তু চুপ রইলো।
ক্লাসের বাইরে এসে রিদি দম ফেলে একটা বেঞ্চে বসলো। ব্যাগ খুলে সব প্যাকেট একসাথে মেলে ধরলো সামনে। অতঃপর তাড়াহুড়া করে খাওয়া শুরু করলো। একবার এই প্যাকেট থেকে, একবার ওই প্যাকেট থেকে কামড় দিচ্ছে। যেন একেকটা কামড় দিয়ে নিজের ভেতরের আতঙ্ক ঢাকতে চাইছে। তার এই অদ্ভুত খাওয়ার ভঙ্গি দেখে আনিকা অবাক হয়ে বললো,
“এভাবে খাচ্ছিস কেনো? মনে হচ্ছে কতদিনের না খাওয়া তুই। আর আহাদ রাজা খাবার পাঠালেই খেতে হবে?”
রিদি মুখ ভর্তি খাবার নিয়েই অস্পষ্ট গলায় উত্তর দিলো,
“থাপ্পড় খাওয়ার থেকে খাবার খাওয়া অনেক ভালো…!”
তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
“এই নে, তুইও খা।” more...
নীলা ঠোঁট ফুলিয়ে আনিকার দিকে তাকালো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“দোস্ত, আমি বাসায় চলে যাচ্ছি।”
“কেনো? তোর আবার কী হলো?”
“কিছুনা… ভালো লাগছে না। মাথা ব্যথা করছে।”
রিদির দিকে একবার তাকালো নীলা, শুকনো একটা হাসি দিয়ে ধীর পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো।
অন্যদিকে একই সময়ে আহাদ রাজা বসে আছে কনফারেন্স হলে। গম্ভীর পরিবেশ, দীর্ঘ টেবিল ঘিরে বসে আছে কেন্দ্রীয় সব নেতা। সামনে নথি, কাগজ, পানির বোতল। চলছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা। টেবিলে রাখা আহাদের ফোনটা হঠাৎ কাঁপতে শুরু করলো। স্ক্রিন জ্বলে উঠলো শাহীনের নাম্বার থেকে ভিডিও এসেছে। আহাদ ফোন হাতে তুলে নিতেই ভিডিও চালু হলো। চোখ আটকে গেলো স্ক্রিনে, রিদি!
বেঞ্চে বসে চারপাশে ছড়িয়ে রাখা খাবারের প্যাকেট থেকে একবার একেকটা তুলে খাচ্ছে। মুখে খাবার ভরা, তার গাল দুটি ফুলে গেছে। মাঝে মাঝে চোখ এদিক-ওদিক করছে। তার এই ভঙ্গি দেখে আহাদ হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলো।
মুহূর্তেই চারপাশের সব নেতা চুপ হয়ে তার দিকে তাকালো। গম্ভীর আলোচনার মাঝখানে আহাদের এমন হাসি যেন বজ্রপাতের মতো পড়লো। আহাদ তা বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ মুখ শক্ত করে নিলো। ফোনটা টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসল। শিরদাঁড়া সোজা করে দু বাহু ঘুরিয়ে, চোখ রাখলো কাগজের দিকে, মুখে অদ্ভুত গম্ভীরতা। সবাই যখন আবার আলোচনায় মন দিলো, তখনও তার ঠোঁটে একফোঁটা চাপা হাসি ফুটে উঠছিল।
সে সেটা ঠোঁট চেপে সংযত রাখলো, কিন্তু বুকের ভেতরে যেন এক মিষ্টি আগুন জ্বলছিল। তার প্রেয়সীকে এভাবে খেতে দেখে, সে অবচেতনেই হাসি চেপে রাখতে পারছে না।
ভার্সিটি শেষ করে রিদিতা আর আনিকা এল মীর হাউজে। আহিয়ার শরীর খারাপ শুনে তারা ভাবলো একটু দেখে যাবে। মূল দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখে, সোফার কোণে গুটিশুটি হয়ে বসে ফোন স্ক্রল করছে আহিয়া। তাদের দেখে হালিমা বেগম অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন।
“আরে! তোমরা!”
রিদিতা আর আনিকা একসাথে সালাম দিল। হালিমা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
“আহি, এই দেখ কারা এসেছে।”
আহিয়া ফোনটা নামিয়ে তাকাতেই চমকে উঠলো।
“আরে তোরা! এই সময়?”
আনিকা মুচকি হাসে বলল,
“ভেবেছি তোর শরীর খারাপ, তাই দেখে যাই। এখন তো দেখি দিব্যি আছিস!”
আহিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আরে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল।”
এমন সময় ধপধপ পায়ে ভিতরে ঢুকলো আদিল। আহিয়ার সাথে তাদের দেখে একটু থমকে দাঁড়াল। অতঃপর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি টেনে এগিয়ে এল,
“হাই বিউটিফুল লেডিস! আমি আদিল মীর।” more...
সে হাত বাড়ালো রিদির দিকে। আদিল মীর শুনে, রিদিতা ঠাণ্ডা গলায় সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
আদিল মুহূর্তেই অবাক হয়ে গেল রিদিতার সরলতা দেখে।অতঃপর নাটকীয় ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
“ওয়ালাইকুম আস সা লা ম…”
আহিয়া বিরক্ত হয়ে কনুই দিয়ে ভাইয়ের পেটে গুতো মারলো,
“যা এখান থেকে!”
আদিল আহিয়ার টেনে দিয়ে বলে, “যাবো না।”
“আদিল্লার বাচ্চা! তোকে একটা লাথি মেরে উগান্ডা পাঠিয়ে দেবো!”
“দে না! আমার তো উগান্ডা যাওয়া অনেক দিনের ইচ্ছা। ”
রাগে কাঁপতে লাগলো আহিয়া। চিৎকার করে বললো,
“চাচি আম্মা! তোমার ছেলেরে কিছু বলো।”
রান্নাঘর থেকে হালিমা বেগম কড়া গলায় বললেন,
“আদি! জ্বালাস না ওদের।”
আদিল হেসে পিছু হটলো, রিদির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলল,
“বাই, বিউটি!”
আবার আহিয়ার চুল টেনে দিয়ে একটা ভেংচি মেরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। তাদের ভাইবোনের কান্ড দেখে আনিকা আর রিদি দুজনেই স্তব্ধ। কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ রিদির চোখ আটকাল একটা সবুজ চোখওয়ালা কালো কুকুর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। রিদি ভয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল। অবুঝ প্রাণীটা খেলতে চায় ভেবে আরেকটু এগিয়ে এল। এতে রিদি ভয়ে তীব্র চিৎকার দিয়ে ছুটে পালাল। কুকুরটাও দৌড়ে গেল তার পিছু নিয়ে। এরপর শুরু হলো ছোটাছুটি। হালিমা বেগম দৌড়ে এসে দাঁড়ালো আহিয়াদের পাশে। আহিয়া চেঁচিয়ে বলল,
“আরে থাম! ও কিছু করবে না তোকে!”
“রিদি.!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! মুহূর্তেই ড্রয়িং রুমে শুরু হলো হট্টগোল। সোফার এপার ওপার, টেবিল ঘুরে রিদি প্রাণপণে ছুটছে, তার পিছু পিছু কুকুরটা।
এমন সময় দরজা দিয়ে ঢুকলেন আহাদ রাজা আর আমজাদ মীর। দুজনেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন সামনের দৃশ্য দেখে। আহাদ থমকে দাঁড়িয়ে রিদির ছোটাছুটি দেখছে। লাল চুড়িদার পরা মেয়েটা যেন আতঙ্কে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। আমজাদ মীরও বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। ঠিক তখনই, ভয়ে দিশেহারা রিদি ছুটে গিয়ে সোজা এক লাফে কোলে উঠে পরলো!
ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সবাই হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে।
সিরিয়াস এসে হাঁপাতে হাঁপাতে আহাদের সামনে দাঁড়ালো। আহাদের চোখের ইশারায় গুটিশুটি হয়ে এক কোণে গিয়ে বসল। এক মূহুর্ত পর আমজাদ মীর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“এবার নামতে পারো মেয়ে। ও তোমাকে কিছু করবে না।”
গভীর কণ্ঠে যেন বজ্রপাত হলো। রিদি হকচকিয়ে তাকালো। যে আমজাদ মীরকে সে এতদিন শুধু টিভি আর পত্রিকায় দেখেছে, আজ তারই কোলে বসে আছে! তড়াক করে নেমে দূরে ছিটকে দাঁড়ালো। আমজাদ মীর ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেলেন। আহিয়া আর আনিকা মুখ চেপে হেসে ফেললো। রিদি একবার ওদের দিকে তাকালো, অতঃপর চোখ পড়লো আহাদের দিকে। তার দৃষ্টি যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। চোখ রক্তিম, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। রিদির বুক ধকধক করে উঠলো, মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,
“লা হাওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আজিম…”
আহাদ ক্রোধ নিয়েই ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। তার গলা ভারি হয়ে উঠলো,
“এই আল্লাহর বান্দি এই! আমারে তোর চোখে পড়লো না? আমার বাপের কোলে গিয়েই লাফিয়ে উঠতে হলো? হাহ! আমার কোলে উঠলে, আমি কি তোকে মানা করতাম, আমি কি তোরে কোলে নিতাম না!”
রিদি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আ… আমি তো কারোর কোলেই উঠতে চাইনি। ও তো ভুল করে…”
“আবার ভুল করে?”
“না না! ভুল করে না!”
“তাহলে কি ইচ্ছে করে!”
“না না… ইচ্ছে করেও না!”
আহাদ দাঁতে দাঁত পিষে গর্জে উঠলো,
“রিদি!!”
“আম্মু!”
একটা চিৎকার দিয়ে আতঙ্কে রিদি হালিমা বেগমের আড়ালে গিয়ে লুকালো। আহাদ একটু এগিয়ে গিয়ে সিরিয়াসের সামনে হাটু গেড়ে বসে, রিদির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সিরিয়াস! ভালো করে মনে রাখবি এই চেহারা। এরপর থেকে যতবার এই বেডিরে দেখবি, ততবার দৌড়ানি খাওয়াবি। তা না হলে তোর খাওয়া বন্ধ। কত বড় সাহস! আমার চোখের সামনে, আমারে রেখে আমার বিয়াইওা বাপের কোলে উঠে! বজ্জাত বেডি!”
রাগে তার বুক উঠানামা করছে। চোখে জ্বলন্ত আগুন, যেন সেই দৃষ্টির তাপে রিদি পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। more...
No comments: