Header Ads Widget

test

#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী (পর্ব) 10

 


#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী

সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। আলো এখনও গাঢ় নীল আকাশে তীব্রভাবে লেগে আছে, তবে হালকা সোনালি আভা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। মীর হাউজের ড্রইংরুমে সেই আভা এসে মিশেছে ভারী পর্দা আর গাঢ় কাঠের আসবাবে। ঘরে উপস্থিত সবাই কোনো না কোনো ভঙ্গিতে বসে আছে। ভারি, গম্ভীর পরিবেশ।
আফরোজা শেখ সবে মাত্র বাইরে থেকে ফিরে এসে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলেন। হাতে ধরা ঠাণ্ডা পানির গ্লাস থেকে ছোট ছোট চুমুক নিচ্ছেন। তার পাশে গম্ভীর মুখে বসে আছেন আমজাদ মীর আর ওপর পাশে আসফাক মীর। সামনের সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে আহাদ। কিন্তু তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে, চোখের ভেতরে রাগের লাল রেখা স্পষ্ট। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, একটু আগের ঘটনার উত্তাপ এখনো তার শরীর থেকে যায়নি। হালিমা বেগম এসে নীরবে কফির কাপ তার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
আহাদ একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে কাপ নিলো, তারপর দৃষ্টি সরাল বাবার দিকে। বিস্মিত চোখে সে বাবাকে পরখ করতে লাগলো। তার চেয়ে কি তার বাবা বেশি সুদর্শন? মনে মনে হিসেব করলো। হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হলো বাবা আসলেই তার চেয়ে ফর্সা। বয়স হলেও চেহারার ঔজ্জ্বল্য আছে। কিন্তু! তাই বলে তার প্রেয়সী গিয়ে তার বাবার কোলে উঠবে! এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
আফরোজা শেখ তীক্ষ্ণ নজরে ছেলের চেহারা লক্ষ করলেন। চোখে ভাঁজ পড়া ভ্রুতে রাগ জমে আছে আহাদের। এক ঝটকা কাঁশির শব্দ করে তিনি বললেন,
“এভাবে তোমার বাবাকে দেখছো কেনো? আবার কি নিয়ে রেষারেষি শুরু হলো দু’জনের মধ্যে?”
আফরোজার কণ্ঠে বিদ্ধ হওয়া প্রশ্নে মুহূর্তেই আমজাদ মীরের চোখ ছেলের দিকে গেল। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করলেন। আহাদ এবার সোজা হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। চোখে কোনো ভণিতা নেই, সরাসরি গলায় বললো, more...
“আম্মা.. তোমার স্বামীকে একটু সামলে রাখো। হুটহাট যাকে-তাকে কোলে নিতে বারণ করো। এতে আমার লোকসান হয়।”
আফরোজার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল এমন কথা শুনে।তিনি কড়া দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালেন। আমজাদ মীর তৎক্ষণাৎ ঠোঁট ভিজিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,
“তোমার ছেলে উল্টোপাল্টা বলছে। বিশ্বাস করো, আমি কিছুই করি নাই! আমাকে ফাঁসাচ্ছে তোমার ছেলে। দেখো, আমি ওর নামে মামলা দেবো। আমার হয়ে তুমি কেসটা লড়ো প্লিজ!”
আহাদ দাঁতে দাঁত পিষে গর্জে উঠলো,
“কেস আমি দেবো, তোমার নামে! আম্মা, তুমি আমার হয়ে লড়বে।”
এই দৃশ্য দেখে আসফাক মীর হাহাকার করে উঠলেন,
“থাম তোরা! মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? দুই বাবা-ছেলে একে অপরের নামে কেস করতে চাইছিস? ভাবি যে ক্রিমিনাল লইয়ার, সেটা ভুলে গেছিস নাকি?”
কথাটা শুনে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল দুজন। বাবা-ছেলে দুজনেই একে অপরের দিকে তাকালো।আশ্চর্যজনকভাবে একই সঙ্গে হতাশ মুখে। দুজনেই গম্ভীর ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসল, যেন কিছুই হয়নি। ঠিক তখনই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো আহিয়া, আনিকা আর রিদিতা। সেই ঘটনার পর থেকে আহিয়ার ঘরে গুটিশুটি মেরে ছিল। কিন্তু বিকেলের আলো ফিকে হয়ে আসছে, এখন আর দেরি করলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তাই তারা নিচে নামলো।
নামার সময়ই রিদির চোখে পড়লো আমজাদ মীর। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এখন নিজের স্ত্রীর কাছে যেন একেবারে মিইয়ে আছেন। এটা রিদির কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। যাকে টেলিভিশনে সর্বদা গম্ভীর, কঠোর ভঙ্গিতে দেখা যায়, তিনি যে স্ত্রীর সামনে এভাবে নমনীয় হতে পারেন, সেটা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তাদের আসতে দেখে আফরোজা শেখ দৃষ্টি ঘুরালেন। রিদি আর আনিকা সম্মান জানিয়ে সালাম দিলো। আফরোজা মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
“তোমার নাম রিদিতা না?”
রিদি মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বললো,
“জ্বি, আন্টি।”
“চলে যাচ্ছো?”
“জ্বি, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। বাসায় যেতে হবে।”
“ওহ, আচ্ছা।”
কিছুক্ষণ চুপ করে গভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন আফরোজা শেখ। তার সেই দৃষ্টি যেন ভেদ করে যাচ্ছে রিদির অন্তর। রিদি অস্বস্তিতে মাথা আরও নিচু করে ফেললো। এদিকে আহাদের ভ্রুর মাঝখানে কুঁচকানো ভাঁজ পড়ে গেল। তার চোখ মুখ খিঁচে উঠলো। ধীরে ধীরে সে বাবার কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
“তোমার হিটলার বউ আমার প্রেয়সীর দিকে এভাবে তাকাচ্ছে কেনো? তার নজর ভালো মনে হচ্ছে না। সাবধান করে দিও।” more...
আমজাদ মীর কটমট করে তাকালেন ছেলের দিকে, কিন্তু মুখে কোনো কথা বললেন না। রিদি আর আনিকা বিদায় নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আহাদ তাদের যাওয়ার দিকেই চেয়ে রইলো। চোখের গভীরতা যেন ডুবে যাচ্ছে রিদির ছাঁয়ায়। তার ঠোঁটের কোণে ফুটলো এক রহস্যময় বাঁকা হাসি।
মীর হাউজের মূল দরজা পেরিয়ে বাহিরে আসতেই রিদিতা আর আনিকা থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। সামনে থেকে হেঁটে আসছে আদনান। মাপা পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে, চোখ দুটো ধারালো, যেন কারো ভেতরটা বিদ্ধ করে দিতে পারে। তাকে দেখেই রিদিতার বুকের ভেতর কেমন জানি একটা হালকা অসস্তি লাগলো। পাশে আনিকাও অবাক হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো।
সে এগিয়ে আসছে নিজের স্বভাবসুলভ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে, সাদ শার্টের হাতা গুটানো, চোখে ক্লান্ত অথচ কঠিন দৃষ্টি। তার চোখ আটকে রইলো রিদিতার মুখে কয়েক মুহূর্তের জন্য, কিন্তু ঠোঁটে কোনো ভঙ্গিমা নেই। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আবার সোজা ভেতরে চলে গেলো। আনিকা পিছন ফিরে তাকিয়ে রইলো তার চলে যাওয়া পর্যন্ত। আলো ছাঁয়ার ফাঁক দিয়ে আদনানের অবয়ব মিলিয়ে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। তারপর ফিসফিস করে রিদির দিকে তাকিয়ে বললো,
“এইটা আবার কে?”
“আহাদ রাজা মীরের বড় চাচার ছেলে, আদনান মীর।”
আনিকা ভ্রু কুঁচকে আবার সেদিকে তাকালো।
“এর নাম তো কখনো শুনি নাই।”
“শুনবি কেমনে? সে একজন ডাক্তার। রাজনীতি পছন্দ করে না, তাই সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে।”
আনিকা হেসে ফেলে,
“এই গম্ভীর লোকটা ডাক্তার? এত রাগ নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করে কেমনে?”
রিদি ঠোঁট কামড়ে হাসি সামলে নিয়ে বলে,
“আমার তো মনে হয় রুগীদের থাপ্পড়ায়া থুপ্পড়ায়া সুস্থ করে দেয়।”
এই কথা শুনে দুজনেই হাসিতে ফেটে পড়লো। রিদি হাঁটু ধরে হেসে নুইয়ে পড়লো, আর আনিকা চোখ মুছতে মুছতে বললো,
“তুই আসলেই একটা পাগল!”
হাসির রেশ কাটতে না কাটতেই তারা গেট পেরিয়ে বাহিরে বের হয়ে গেলো। দুইজনের বাসার পথ আলাদা। আনিকা একটা রিকশা থামিয়ে উঠে চলে গেলো। রিদি একটু হেঁটে সামনের গলি থেকে রিকশা নেবে ভেবে এগিয়ে গেলো।
কিন্তু হঠাৎ তার সামনে এসে থামলো কয়েকটা কালো গাড়ি। গর্জে উঠলো ইঞ্জিন, মুহূর্তেই চারপাশ যেন থেমে গেলো। রিদিতা একঝলকেই চিনে ফেললো, এগুলো আহাদ রাজার গাড়ি।
তার বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হলো। কণ্ঠ শুকিয়ে গেলো। সে তাড়াতাড়ি ওড়নাটা ঠিক করে নিলো, বুকের উপর টেনে নিলো আরও শক্ত করে। তার হাতের তালু ঘামে ভিজে গেলো। বুকের ভেতরটা যেন ধপধপ শব্দ করছে, মনে হলো চারপাশের সবাই শুনে ফেলবে। মনে মনে প্রশ্ন করলো রিদি,
“কিছুক্ষণ আগেই তো মীর হাউজে ছিলো। এত দ্রুত এখানে এলো কিভাবে?”
তার ভাবনার মাঝেই সামনের গাড়ির দরজা খুলে গেলো।
ভেতরে বসে আছে আহাদ রাজা মীর। কালো শার্টের হাত গুটানো, পায়ের উপর পা তুলে বসা, চোখে কালো চশমা। তার চুলগুলো হাওয়ায় একটু একটু দুলছে। ভঙ্গিটা শীতল অথচ তার কাছে ভ'য়ংক'র। রিদির চোখ এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো তার দিকে। নিজের অজান্তেই ঘাড় হালকা কাত হয়ে গেলো। আবার দ্রুত মাথা নাড়িয়ে নিজেকে সামলে নিলো। ড্রাইভার নেমে এসে ভদ্র ভঙ্গিতে বললো,
“গাড়িতে উঠুন ম্যাম।”
কিন্তু রিদি দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়। ভেতরে ভেতরে দৌড়ে পালাতে চাইছে, তবু পা নড়ছে না। বাসায় সবাই ছিলো বলে তখন বেঁচে গেছে, নইলে নিশ্চিত কানে ধরে উঠবস করতে হতো তার। হঠাৎ আহাদ রাজা ভেতর থেকে গর্জে উঠলো, more...
“আপনাকে কি আমার আলাদা করে ইনভাইট করতে হবে?”
রিদির বুক ধপাস করে নেমে গেলো নিচে। সে দ্রুত ঘুরে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করলো। ঠিক তখনই আবার সেই ভয়াল গর্জন কানে এলো,
“আহাদ রাজা সব কিছুতে দু’বার অপশন দেয়। তৃতীয়বারে অ্যাকশন নেয়।”
পা জমে গেলো রিদির। নিঃশ্বাস গলা আটকে গেলো। ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালো গাড়ির ভেতরে। আহাদ আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে, কিন্তু এবার মাথাটা সামান্য কাত করে তাকিয়েছে রিদির দিকে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত কঠিন হাসি। দু’আঙুল তুলে ইশারা করলো কাছে আসতে।
বাধ্য হয়ে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলো রিদিতা। বুকের ভেতর ঢাকের মতো বাজতে লাগলো হৃদপিণ্ড। অবশেষে সে গাড়ির কাছে গিয়ে একটু দাঁড়িয়ে থেকে, ভারী শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ভেতরে ঢুকে বসল।
গাড়ি চলতে শুরু করলো। ভেতরে নীরবতা। তার বুক এখনও দ্রুত উঠানামা করছে। হাত কাঁপছে। আহাদ কোনো কথা বললো না। শুধু সোজা সামনে তাকিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইলো। রিদি কয়েকবার আড়চোখে তাকালো তার দিকে। আবার তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিলো। তারপর সেও সোজা সামনে তাকিয়ে রইলো।
তবে সে বুঝলো না আহাদ সামনের আয়না দিয়ে বারবার তাকিয়ে তাকেই দেখছিলো। রিদি নিজের ব্যাগ আঁকড়ে ধরেছে, ঠোঁট কামড়াচ্ছে বারবার। উত্তেজনায় হাত কাঁপছে। তার প্রেয়সীর হাবভাব দেখে আহাদ হালকা মুচকি হাসলো।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আদনান তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছলো। পানির ফোঁটা চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গলায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত নিজেকে পরখ করলো। মুখে দাড়ি-গোঁফের হালকা রেখা ফুটে উঠেছে, চোখের গভীরতা, ভ্রু-কুঁচকে থাকা স্বভাবসুলভ গম্ভীরতা।সবকিছু যেন তার ব্যক্তিত্বকে আরও ভারী করে তুলেছে।
কিন্তু তার চোখ দ্রুত চলে গেলো বুকশেলফের দিকে। তারপর টেবিলের দিকে, সেখানে রাখা একটি ছোট প্যাকেট। সে নিঃশ্বাস নিয়ে এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করলো, মাথাটা সামান্য উঁচু করে রাখলো। যেন নিজেকেই কিছু বোঝাচ্ছে। অতঃপর পর দরজার কাছে গিয়ে হালকা গলায় ডাক দিলো,
“আদিবা... আদিবা...”
কিছুক্ষণের মধ্যেই টুপটাপ শব্দ তুলে দৌড়ে এলো আদিবা। চোখে ঝিলিক, চুল হালকা এলোমেলো হয়ে আছে। হয়তো খেলছিলো।
“কি হলো ভাইয়া, ডাকছো?”
আদনান মাথা নেড়ে টেবিলের দিকে ইশারা করলো।
“ওইটা নিয়ে যা।”
আদিবা এগিয়ে গিয়ে হাতে নিলো প্যাকেটটা। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি আছে এর ভেতর?”
বলতে না বলতেই প্যাকেটটা একটু ফাঁক করে উঁকি দিলো ভেতরে। মুহূর্তেই তার চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠলো।
“চকলেট...!” more...
আদনান কোনো উত্তর দিলো না। শুধু আস্তে আস্তে কয়েক কদম হেঁটে গিয়ে বিছানায় বসল। ঠাণ্ডা চোখে বোনের খুশি দেখা শেষ করে নরম স্বরে বললো,
“তুই আর আহি ভাগ করে নিস।”
“আচ্ছা ভাইয়া!”
বলেই আদিবা লাফিয়ে চলে গেলো। আদনান বসে রইলো স্থির হয়ে, দরজার দিকেই তাকিয়ে। যেন কিছু ভেবে যাচ্ছিলো। চোখের কোণে হালকা ক্লান্তি, ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই। আদিবা দৌড়ে গিয়ে আহিয়ার রুমে ঢুকলো। হাতে ধরা প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে খুশিতে বলে উঠলো,
“এই নাও, তোমার চকলেট!”
“আহিয়া চমকে তাকালো, চকলেট? কে দিয়েছে?”
“আদনান ভাই।”
“আদনান ভাই?”
আহিয়া থমকে গেলো। বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন জানি গরম হয়ে উঠলো। মনে পড়লো, গতকাল আদিল ওর চকলেট খেয়ে ফেলায় কতটা চেঁচামেচি করেছিলো। তবে কি আদনান ভাই সেটা শুনে ফেলেছে? তাই হঠাৎ আজকে... ভাবনায় ডুবে গিয়ে ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো। কিন্তু তার চিন্তার মাঝে আদিবা আবার খোঁচা দিলো,
“এতো খুশি হয়ো না। আমার জন্য এনেছিলো, তাই তোমাকেও দিলাম।”
মুখটা উল্টে আদিবা চলে গেলো। আহিয়া কিছুক্ষণ বোকার মতো বসে রইলো, মাথা ঝাঁকিয়ে সব চিন্তা দূরে ঠেলে দিলো। একটা চকলেট খুলে মুখে দিতেই হঠাৎ দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো আদিল। সে লাফিয়ে এসে ধপাস করে বিছানায় পড়লো। আহিয়া খেঁকিয়ে উঠলো,
“আমার রুমে কেন আসছিস তুই! যা এখান থেকে!”
আদিল ভঙ্গিমা করে শুয়ে বললো,
“আমি কেন যাবো? যাবি তো তুই! এ বাড়ি ছেড়ে শশুড়বাড়ি চলে যাবি। আহারে! ভেবেই আমার এখনি কান্না আসতেছে।”
“আদি...! আমি তোর ঘাড় মটকে দিবো।”
আদিল এক ঝটকায় হাত বাড়িয়ে আহিয়ার হাত থেকে চকলেটটা ছিনিয়ে নিলো। মুহূর্তেই মুখে পুরে দিলো। উঠে লাফাতে লাফাতে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
“শাঁকচুন্নিরা এটাই করে।”
“আদিল্লার বাচ্চা...!”
আহিয়া ক্ষেপে গিয়ে কুশন তুলে ছুঁড়ে মারলো তার দিকে।
কিন্তু আদিল মাথা নিচু করে এড়িয়ে গেলো। কুশন গিয়ে সরাসরি আঘাত করলো সামনে দাঁড়ানো এক অচল দেয়ালের মতো মানুষটার মুখে। আদনান। হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে কোনো রাগ নেই, তবে চোখের দৃষ্টিটা ঠাণ্ডা আর গভীর। আদিল তৎক্ষণাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো, তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“সরি ভাই... আমি না, আহিয়া।”
বলে দৌড়ে পালালো। মুহূর্তেই আহিয়া জমে গেলো। শরীর যেন পাথর হয়ে গেছে। মুখ শুকনো, হাত-পা কাঁপছে। শুধু চোখ দুটো বড় হয়ে স্থির হয়ে আছে আদনানের দিকে।
আদনান ধীরে ধীরে কুশনটা হাতে তুলে নিলো। কোনো শব্দ না করে পা ফেলে এগোতে লাগলো আহিয়ার দিকে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে মেঝের শব্দ যেন আহিয়ার বুকের ভেতর ধ্বনি তুলছে। আহিয়া ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। মনে হলো এখনই হয়তো বকুনি দেবে, কিংবা...
আদনান এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে শান্ত চোখে তাকালো আহিয়ার মুখের দিকে। তার নিঃশ্বাসের ভেতর ভয়ের কাঁপুনি শোনা যাচ্ছিলো। তারপর হালকা করে ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা অচেনা মুচকি হাসি দিলো। কোনো শব্দ না করে পাশ কাটিয়ে চলে সেখান থেকে। আহিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কয়েক মুহূর্ত পর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে সাহস করে চোখ খুললো। কিন্তু সেখানে আদনান নেই।
ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলো সে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে। সেই স্বভাবসুলভ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে।
আহিয়ার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠলো। কিছু বুঝতে পারলো না। শুধু মাথাটা সামান্য কাত করে একঝলক তাকিয়ে মাথা চুলকে আবার রুমে গিয়ে বিছানায় বসে পড়লো।
গাড়ি এসে থামলো মিরপুর এগারোর এক নিঃশব্দ গলিতে, রিদির ভবনের সামনে। চারপাশ নিস্তব্ধ শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের হালকা গুঞ্জন আর দূরে কোথাও ঘেউ ঘেউ করা কুকুরের শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। গাড়ির ভেতরটাও যেন সেই নীরবতার সাথে মিশে গেলো। রিদি শেষবারের মতো তাকালো আহাদের দিকে। বিস্মিত চোখে খেয়াল করলো, আহাদ এখনো আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে। ঠান্ডা, নিশ্চুপ, একদম অচঞ্চল। তার মুখে রাগের সামান্যতম ছাঁপও নেই। অথচ রিদি ভেবেছিলো এবার বুঝি ঝড় উঠবে, আহাদ রেগে আগুন হয়ে তাকে কান ধরে উঠবস করাবে, কিংবা কোনো না কোনোভাবে শাস্তি দেবে। কিন্তু আশ্চর্য, সব প্রত্যাশা ভেস্তে দিয়ে আহাদ বরং অদ্ভুত এক শান্ত, বরফ-ঠান্ডা ভাব নিয়ে বসে আছে। এই অদ্ভুত ভঙ্গি রিদিকে আরও বেশি অস্থির করে তুললো। more...
চালক গাড়ি থেকে নেমে এসে ধীরে দরজা খুলে দিলো। রিদি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে, ওড়নাটা একটু গুছিয়ে নিয়ে নামার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ বিদ্যুতের মতো আহাদের হাত তার কব্জি চেপে ধরলো। চমকে উঠলো রিদি। তার নরম শরীরটা হঠাৎ করে কেঁপে উঠলো। আতঙ্ক আর বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ঘুরে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেলো আহাদের গভীর, গাঢ়ো বাদামি ঘন পাপড়িযুক্ত চোখের সাথে। সেই দৃষ্টিতে যেন অজস্র অগ্নি লুকিয়ে আছে, আবার একই সাথে এক অদ্ভুত টানও। রিদির বুক ধক করে উঠলো, নিশ্বাস ভারী হয়ে গেলো।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“ক.. কি হয়েছে? কিছু বলবেন?”
আহাদ এক মুহূর্ত কোনো উত্তর দিলো না। শুধু তাকিয়ে রইলো সেই কোমল, ভীত চোখের দিকে। রিদির মুখের সরল ভঙ্গিমায়, সেই নরম গাল আর লাজুক দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত মাদকতা ছিলো, যা মুহূর্তের জন্য আহাদের সমস্ত রাগকে বরফে গলিয়ে দিতে চাইলো। মনে হলো, এই মেয়েটার দিকে তাকালে তার সমস্ত কঠোরতা, সমস্ত অভিমান ভেঙে যাবে। কিন্তু না পরের মুহূর্তেই সেই ঘটনাটা মনে পড়তেই আহাদের চোখে আবার আগুন জ্বলে উঠলো। চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, কপালের শিরাগুলো টানটান হয়ে উঠলো। সে ধীরে ঝুঁকে এলো রিদির কাছে, দাঁত কিড়মিড় করে ফিসফিস স্বরে বলল,
“আজকে প্রথম এই ভুল করেছিস, তাই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এর পরে যদি আর কখনো এমন হয়... মনে রাখিস, শুধু সিরিয়াস আর কোকো না, পুরো শহরের কুকুরকে তোর পিছনে লেলিয়ে দেবো। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নে, জানু।”
ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো রিদির। ঠোঁট দিয়ে জ্বিব ভিজিয়ে নিলো, চোখ পিটপিট করতে লাগলো, যেনো কিছু বলতে চায় কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। আহাদ হঠাৎ হাতটা ঝটকা মেরে ছেড়ে দিলো। কঠিন স্বরে বলল,
“যাও এখন। কুইক।”
এক মুহূর্তও দেরি করলো না রিদি। হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। হাওয়ার সাথে তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলো। আহাদ চুপচাপ বসে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ভ্রু কুঁচকে নিজেকেই বিড়বিড় করে প্রশ্ন করল,
“আমাকে ভয় পেলো, না কুকুরকে?”
কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলো তার দৃষ্টি। তারপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাকটা ঘষে নিয়ে মাথা এলিয়ে দিলো সিটের সাথে। চোখ বন্ধ করতেই বুক ভরে এলো দীর্ঘ এক নিঃশ্বাসে। গাড়িটা ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করলো, আর সেই নিরবতা আবার গিলে নিলো সব শব্দ।
ঈশানী রান্নাঘরে ব্যস্তততার মধ্যে আছে। রান্নাঘর থেকে হালকা সুভাষ ছড়িয়ে পরেছে পুরো ঘরে। এদিকে ছোট্ট মাহিকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে দিয়েছে পড়তে। আজকালকার বাচ্চাদের তো ফোন ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না। ফোন দেখতে দেখতে পড়াশুনার প্রতি অনিহা করে। তবে মাহি সে দিক দিয়ে একটু ভালোই, অন্তত টেবিলে বসলে খাতা-কলমে মন দেয়।
ঠিক তখনই হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। গ্যাসের আঁচটা সামলে ঈশানী তাড়াহুড়া করে এসে দরজা খুললো।
দরজা খোলার সাথে সাথেই ভেতরে ঢুকলো রিদিতা। মুখটা পুরো ভার করা, চোখেমুখে অস্থিরতা। পা থেকে জুতা খুলে ফেলে দিলো এক পাশে, এমনকি ছুড়ে মারা বললেও কম বলা হবে। ঈশানীর ভ্রু কুঁচকে গেলো,
“কতবার বলেছি, জায়গার জিনিস জায়গায় রাখবি! তোর ভাইয়ার এসব একদম পছন্দ না। দেখলেই রাগ করে, জানিস না?”
রিদি শুকনো গলায় উত্তর দিলো,
“জানি।”
“জানিস, কিন্তু শুনিস না! সমস্যা কী তোর? সারাদিন বাইরে থাকলে হাসিখুশি, আর বাসায় পা রাখলেই মুখ পেঁচার মতো কেনো হয়ে যায়?”
কথাগুলো রিদির কানে ঢুকলো ঠিকই, কিন্তু তার ভেতরের জ্বলন্ত আগুনটা আরো দ্বিগুণ হলো। সে রাগে চোখ বড় বড় করে কটমট করে তাকালো বোনের দিকে। আজকের দিনটা তার জন্য একদমই সহজ ছিল না। সকাল থেকে একটার পর একটা ধকল গেছে তার উপর দিয়ে। তার উপরে সেই আহাদ রাজার কুকুরের দৌড়ানি, ত্যাড়া কথা, আর হুমকি... সব মিলিয়ে মাথাটা যেন ফুটতে থাকা প্রেসার কুকার। আর এখন ঈশানীর ছোটখাটো বকা শুনে সেটা ফেটে বেরোলেই হয়।
রুমে ঢুকে ব্যাগটা ধপ করে ছুড়ে মারলো বিছানায়। তারপর ঝটকা দিয়ে ওড়নাটা খুলে আলনায় ছুড়ে দিলো। বুক ধড়ফড় করছে, রাগে শ্বাস ভারি হয়ে উঠছে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে লাগলো। ঈশানী চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে একটু নরম গলায় বললো, more...
“তেজ পরে দেখাইস। মাগরিবের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে। আগে নামাজ পড়ে নে।”
রিদি বিরক্ত হয়ে তাকালো বোনের দিকে। ঠোঁট চেপে ধরলো, যেনো কিছু বলতে চাইছে কিন্তু নিজেকে সামলালো। ঈশানী আবার রেগে বললো,
“নামাজের কথা বললেই, মুখটা অন্ধকার হয়ে যায় কেনো তোর?”
কোনো উত্তর দিলো না রিদি। সোজা হাঁটা দিলো ওয়াশরুমের দিকে, গিয়ে দরজায় এমন জোরে লাথি মারলো যে শব্দে ঘর কেঁপে উঠলো। তারপর ভেতরে ঢুকে গেলো। কিছুক্ষণ পরই বের হয়ে এলো ভেজা মুখে। হাত মুখ মুছে নিয়ে, হিজাব মাথায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেলো জায়নামাজে।
এমন সময় আবার কলিং বেল বেজে উঠলো। ঈশানী ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। এবার ফিরেছে সুমন, অফিসের ক্লান্তি নিয়ে। ভেতরে ঢুকে প্রথমেই চোখ বুলালো ড্রইংরুমে। ছোট্ট মাহির খাতার দিকে একবার তাকালো, তারপর রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো রিদি নামাজে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তুষ্টির মাথা নেড়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। সুমন প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ। তার কাছে বাসার প্রতিটি জিনিসের জায়গা আলাদা। একটু এদিক-ওদিক হলেই চোখে পড়ে। একটা ধুলোর কণাও সহ্য হয় না তার। তাই ছোট বাসাটা সবসময় ঝকঝকে থাকে। ঈশানীও চেষ্টা করে তার এই অভ্যাসের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে।
রিদি নামাজ শেষ করে এসে সোফায় হুঁকো-হাঁটু ভাজ করে বসলো। টেবিলে রাখা বিস্কুটের বয়ামটা টেনে নিয়ে খুলে একটার পর একটা বিস্কুট খেতে শুরু করলো। যেনো তার সমস্ত রাগ, অভিমান, কষ্ট সব বিস্কুটের উপর ঝাড়ছে। অথচ এই মেয়েকে মাসে একটা বিস্কুটও জোর করে খাওয়ানো যায় না। আর আজ সে যেন একাই বয়াম শেষ করবে। ঈশানী রান্নাঘর থেকে এসে বয়ামটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বিরক্ত গলায় বললো,
“নিজের উপর অত্যাচার করা বন্ধ কর। আমি নুডুলস রান্না করছি, নুডুলস খা।”
রিদি কিছুক্ষণ নীরব রইলো। অতঃপর হঠাৎ চার হাত পা ছুঁড়ে দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলো,
“আম্মউউউউউউ...!!!”
তার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হলো পুরো ঘরের দেয়াল জুড়ে। more...

No comments:

720

Powered by Blogger.