Header Ads Widget

test

#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী (পর্ব) 11

  




#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী

রাত গভীর হালকা গভীর হয়ে এসেছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে এমনভাবে, যেনো আকাশ নিজেই কান পেতে শুনছে কারো গোপন কথা। মীর হাউজের উঁচু গেট ধীরে ধীরে খুলে গেলো, আর ভেতরে ঢুকলো একে একে আহাদ রাজার কালো গাড়িগুলো। সামনের হেডলাইটের আলো মুহূর্তের জন্য আঙিনার নীরবতা ভেঙে দিলো। গাড়ি এসে থামতেই, মাঝখানের গাড়ি থেকে নামলো আহাদ রাজা। কালো প্যান্ট-শার্টে আবৃত শরীর, আলতো হাতে চুলে আঙুল বুলিয়ে নিলো সে। যেনো সারা দিনের ধুলো ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। গাড়ির বনেটে হেলান দিলো, মাথাটা উঁচু করে তাকালো রাতের আকাশের দিকে।
অপরিসীম অন্ধকারে এক টুকরো আলো, একটা তারা ঝিকিমিকি করে জ্বলছে। আহাদ হাত বাড়িয়ে দিলো, যেনো তারাটাকে ছুঁতে চাইছে। ঠোঁটে এক চিলতে বাঁকা-হাসি, চোখে এক অদ্ভুত ক্লান্তি। বুক থেকে বের হলো একটা ভারী নিশ্বাস, যা রাতের হাওয়ার সাথে মিশে গেলো।
ঠিক তখনই পাশে এসে দাঁড়ালো শাহীন। কিছুক্ষণ আহাদের দৃষ্টি অনুসরণ করলো সে, অতঃপর ধীরে গলায় বললো,
“ভাই...”
আহাদ চোখ না নামিয়ে গম্ভীর গলায় জবাব দিলো,
“হুম।”
শাহীন একটু ইতস্তত করে বললো,
“খলিল মাতব্বর বোধহয় কোনো ষড়যন্ত্র করছে। খবর আসছে, তার লোকজন চারদিকে ছড়িয়ে দিছে। আমাদের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে।”
আহাদের ঠোঁটে আবারো সেই অদ্ভুত হাসি ফুটলো।আকাশের দিকেই তাকিয়ে বললো,
“পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। প্রবাদটা শুনছিস না?”
“হ ভাই, শুনছি।”
“ওরে উড়তে দে শাহীন। তবে বুঝতে যেনো না পারে, আমরা জানি ও কী খেল খেলতেছে। সময় এলে হিসেব কষা হবে।”
“ঠিক আছে ভাই।”
আর কোনো কথা না বলে আহাদ সোজা ভেতরে ঢুকে গেলো। ড্রইংরুমের টেবিলে বই-খাতা ছড়িয়ে বসে আছে আদিবা। মনোযোগ দিয়ে লিখছে, পাশে বসে আদনান সাহায্য করছে তাকে। টেবিলের অপর প্রান্তে বসে আছেন আসফাক মীর। আহাদ ভেতরে ঢুকে সরাসরি গিয়ে বসলো চাচার পাশে। আলতো করে দুজনে একে অপরের হাতে চাপড় দিলো, একরকমের হাই ফাই। তবে তাতে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়া লুকানো।
আহাদের দিকে তাকিয়ে আদিবার মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠলো। আহাদ এক চোখ টিপে দিলো বোনের দিকে। মুহূর্তেই আদিবা খিলখিল করে হেসে উঠলো। এ দৃশ্য মোটেও ভালো লাগলো না আদনানের। সে সঙ্গে সঙ্গে আদিবার খাতাটা টেনে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললো,
“কতবার বলেছি পড়াশোনায় মন দে! পড়াশোনা না করলে হবে? পড়াশোনা করে যে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে!
এ কথাটা বলেছিলাম না?”
আহাদ পা ছড়িয়ে এবার হেলে বসল। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেলো। শান্ত অথচ ধারালো ব্যাঙ্গাত্মক সুরে জবাব দিলো,
“হাহ... যারা পড়াশোনা করে নাই, তারা তো ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ সব জায়গায় পায়ে হেঁটে যায়?”
কথাটা শুনে আদিবা খিলখিল করে হেসে দিলো। আদনান অপমানিত হলো কিছুটা। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলল,
“এটা কথার কথা।”
“যে কথার যুক্তি নাই। সেটা কথার কথা হবে কেন?”
“যুক্তি দিয়ে জীবন চলে না।”
“চারটা চাক্কা লাগায়া নিলেই চলব।”
আদিবা আবারও হেসে দিলো। এবার আসফাক মীরও নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলেন না, তিনিও হেসে ফেললেন। আদনান রাগে লাল হয়ে গেলো। আহাদের সাথে কথায় কাজে সে কখনোই পেরে উঠবে না। মনে মনে দাঁত চেপে চুপ করে গেলো। কারণ সে জানে, অযথা লড়াই করলে অপদস্থ হবেই, জেতার কোনো সুযোগ নেই। আহাদ হালকা হাই তুলে দুই হাত উঁচু করে শরীরটা টানলো, যেনো অলসতা ঝেড়ে ফেলছে।
অতঃপর দাঁড়িয়ে যাওয়ার আগে আবারো আদিবার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিলো। আদিবা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এরপর ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো আহাদ রাজা।
সকাল তখন সাতটা পঁইতাল্লিশ। শহরের বাতাসে হালকা মিষ্টি গন্ধ, রাস্তার ধারে গাছের পাতায় জমে আছে ধুলো বালি। ভিতরে ঘড়ির টিকটিক শব্দটা ভেসে আসছে।
আফরোজা শেখ আজ যথারীতি খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছেন। বিছানার ওপর সুন্দরভাবে ভাঁজ করা ধূসর শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিলেন। চুল সেট করা, হাতে সোনার পাতলা চুড়ি। একেবারে আদালতের জন্য প্রস্তুত এক নারী অভিজ্ঞ, আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়চেতা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলার মুক্তার মালাটা একবার ঠিক করে নিলেন, তারপর গম্ভীর মুখে হাতে কালো পোষাকটা তুলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
তার পদচারণায় পুরো করিডোর জুড়ে গম্ভীর এক ছন্দ বাজতে লাগল। মূল দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। বাইরে তখন সূর্যের রশ্মি পুরোপুরি ছড়িয়েছে। কিন্তু আফরোজা শেখের চোখে অন্য এক সিদ্ধান্তের আলো।
তিনি হঠাৎ ঘুরে তাকালেন। ডাইনিং টেবিলে ব্যস্ত হালিমা বেগম তখন সকালের নাশতার আয়োজন করছেন। কপালে হালকা ঘাম জমেছে, শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে গোছাচ্ছিলেন। আফরোজা গম্ভীর গলায় ডাক দিলেন,
“হালিমা!”
হালিমা আঁচলটা কপাল থেকে সরিয়ে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এলেন।
“কি হয়েছে আপা? কিছু বলবা?”
আফরোজা এক মুহূর্ত চুপ রইলেন। কপালে এক আঙুল বুলিয়ে একটু চুলকে নিলেন। চোখের দৃষ্টি শক্ত হলো।
“আহিয়ার যে বান্ধবি আছে না? রিদিতা। মেয়েটাকে তোমার কেমন লাগে?”
হালিমা একটু অবাক হলেও উত্তর দিলেন দ্বিধাহীন কণ্ঠে,
“রিদিতা! মেয়েটা আসলেই অনেক ভালো। অনেক সরল-সোজা, ভদ্র। কেনো আপা, কি হয়েছে?”
আফরোজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্তভাবে বললেন,
“কিছু না। তুমি শুধু ওর বাবা-মায়ের নাম্বারটা যোগাড় করে দিও তো পারলে।”
“আচ্ছা দেবো… কিন্তু আপা…”
আফরোজা শেখ দৃঢ় কণ্ঠে থামিয়ে দিলেন,
“কিন্তু টিন্তু কিছু না হালিমা। তুমি যদি পারো, ভালো। না পারলে আমি নিজেই ব্যবস্থা করবো।”
“ঠিক আছে আপা, আমি নিয়ে তোমাকে দিবো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আসছি।”
তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে দরজার দিকে হাঁটলেন। চওড়া দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। জুতার শব্দ গটগট করে প্রতিধ্বনিত হলো পুরো হলঘর জুড়ে। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসতেই, মিনিট খানেকের মধ্যেই সাদা গাড়িটা আদালতের পথে ছুটে চলল। হালিমা বেগম কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। দরজার ওপাশে গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যেতেই গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন সামনের ফাঁকা আঙিনার দিকে। তার মনে সন্দেহ ভর করলো। আন্দাজ করতে পারছেন কিছু একটা। আফরোজা শেখ কখনোই হুট করে কারো নাম্বার চাইতে বলবেন না।
তবুও তিনি নিশ্চুপ রইলেন। জানেন, আফরোজা শেখ যা বলেন না, সেটা তিনি নিজে থেকে জানা বা বোঝার চেষ্টা করলেও লাভ নেই। একটা হালকা নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে ফিরে গেলেন। টুংটাং শব্দ আবারও ভেসে উঠলো ঘরে।
পুরো বিছানা জুড়ে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে রিদিতা। তার নিঃশ্বাসের ভেতর অলসতার ছন্দ বাজছে। হঠাৎ ফোনের এলার্ম কানে ঢুকে বিরক্তিকর শব্দ তুলতেই সে ঘুম ভেঙে আধো-জাগ্রত ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে ফোনটা খুঁজতে লাগল। চোখ না খুলেই আঙুলে মুঠো করে এলার্ম বন্ধ করল। কিন্তু মিনিট খানেক পর আবারো এলার্ম বেজে উঠলো। রিদিতা এবার ভ্রু কুঁচকে চোখ বন্ধ করেই ফোনটা ধরে আনমনে বন্ধ করলো। বিরক্তি যেনো কপালের ভাঁজে জমে আছে। ঘুমের ভেতর থেকেই দু’হাত দুই দিকে মেলে দিয়ে গা টানলো। তারপর দুলতে দুলতে উঠে বসল বিছানায়। চোখের পাতা যেনো কেজির পর কেজি ওজন নিয়ে ঝুলে আছে।
কাল রাতে ঘুম আসেনি ঠিকমতো। হাজারো চিন্তা তাকে পিষে রেখেছিলো। তাই ভোরের আলোতেও তার চোখ খুলতে পারছিলো না। একবার হাই তুলে দুই হাত মাথার উপরে তুললো। ঠিক তখনই জানালার পর্দা ফাঁক গলে সূর্যের রশ্মি সরাসরি এসে পড়লো তার চোখে। চোখ কুঁচকে গেলো, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গাল আর কপালে লেপ্টে আছে।
অনেক যুদ্ধ করে ধীরেধীরে চোখ মেলে তাকালো সামনের দেয়ালে। তারপর হঠাৎই থম মেরে বসে থাকলো। ভার্সিটি যাওয়ার একবিন্দু ইচ্ছেও নেই তার। ক্লান্তি, অনীহা, বিরক্তি সব মিলে বুক চেপে ধরেছে। কিন্তু আজকের ক্লাসটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাদ দিলে ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই চাইলেও ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। ইতোমধ্যে দেরি হয়ে যাচ্ছে। পা দুটো নামালো মেঝেতে, কিন্তু তবুও খানিকক্ষণ ঝিমু ঝিমু করে বসে রইলো। ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে ঈশানীর ডাক ভেসে এলো,
“রিদি, তাড়াতাড়ি কর! পরে আবার বলবি সময় নাই।”
ঈশানীর সেই কণ্ঠস্বর যেনো হুইসেলের মতো কানে বাজলো। চমকে উঠে ধড়ফড় করে দাঁড়িয়ে গেলো রিদিতা। হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে টলতে টলতে পড়ে যেতে যাচ্ছিলো, শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলো। মাথা ঝাঁকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। ক্লান্ত মুখটা একটু শক্ত করে নিজের সাজগোজে মন দিলো। গাঢ় কফি রঙের চুড়িদার পরে নিলো। চুলগুলো পেছনে নিয়ে ক্লিপে আটকে রাখলো। এরপর ওড়নাটা মাথায় গুছিয়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেললো, ব্যাগটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
ড্রইংরুমে এসে নাশতার টেবিলে বসল। সামনের প্লেটে সাজানো রুটি, ভাজি, ওমলেট। খাবার দেখেই তার পেটের মধ্যে মোচড় দিলো। সকাল সকাল খেতে তার একদমই ইচ্ছে করে না। তবে আহাদ রাজার কথা মনে হতেই মুখ শক্ত হয়ে গেলো। কালকের ঘটনা, কথাবার্তা, তার চোখের দৃষ্টি সব মনে পড়লো। নিজের মনকে শাসন করে বললো,
“আজ আর কোনো তামাশা করবে না, শান্ত থাকতে হবে।”
জোর করে দু’কামড় মুখে তুললো। খাবার গলা দিয়ে নামছে না, তবুও জোর করেই কিছুটা খেয়ে নিলো। ঠিক তখনই ঈশানি এগিয়ে এসে বললো,
“শোন, তুই যাচ্ছিসই তো, যাওয়ার সময় মাহিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাস। আমি আর শুধু শুধু বেড়োবো না।”
রিদিতা চুপচাপ মাথা নাড়লো।
“আচ্ছা।”
ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। অথচ মাহি এখনো টেবিলে বসে, খাবার শেষ করছে না। ছোট্ট হাতে চামচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খাচ্ছে, চোখে তখনো ঘুমের ছাঁপ। রিদিতা বিরক্ত হয়ে গলা উঁচু করে বললো,
“খা না তাড়াতাড়ি! দেরি হয়ে যাবে।”
মাহি তবুও হাই তুলে ধীরে ধীরে খাবার গিলছে। রিদিতার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো।
“খাওয়া লাগবে না। চল!”
বলেই মাহির ব্যাগটা তুলে নিলো হাতে। মাহিকে আধো-ঘুমন্ত অবস্থায় টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাইরে। দরজার ধাক্কা হালকা শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেলো তাদের পেছনে। ঈশানি কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলো ভেতরে। নাশতার টেবিলে পড়ে থাকা অসমাপ্ত খাবারের দিকে তাকালো, অতঃপর নিঃশব্দে দরজার কাছে গিয়ে খিল টেনে বন্ধ করে দিলো। ঘরে আবার নীরবতা নেমে এলো।
ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের ভেতরে যেন ক্লান্তির হাওয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। পাঁচ-ছয় জোড়া পা ধীরে ধীরে গার্ডেনের পাশের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসে। ভেতরে ভেতরে সবাই ক্লান্ত, কিন্তু মুখে তবুও হাসি-ঠাট্টার রেশ লেগে আছে। সিঁড়ির ধাপে দুলতে দুলতে বসলো তারা। মুহূর্তের মধ্যেই শুরু হলো গল্পগুজব। আনিকার সেই পুরোনো দুঃখের কাহিনি বেরিয়ে এলো আবারও সেটা নিয়ে আহিয়া আর নীলা হো হো করে হাসছে। তাদের প্রাণখোলা হাসিতে চারপাশের পরিবেশটা যেন আরও হালকা হয়ে গেলো।
কিন্তু সেই হাসির মাঝেই একেবারে উল্টো ছবি রিদিতার। মুখ ভার করে উরুর সাথে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে। চোখে-মুখে অদ্ভুত এক গাম্ভীর্য, যেন গভীর কোনো ভাবনায় ডুবে গেছে। চারপাশের হাসি-ঠাট্টা যেন তার কানে ঢুকছে না, সে নিজের জগতে নিমগ্ন। রিদিকে এভাবে দেখে আনিকা আর চুপ থাকতে পারলো না।
“কিরে, তোর আবার কি হলো? মুখটা এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রাখছোস কেন?”
আনিকা হেসে ধাক্কা দিতেই রিদির শরীরটা একটু দুললো। কিন্তু তবুও সে একইভাবে বসে রইলো, একটুও সাড়া দিলো না। তাদের পাশে বসে তামিম অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ তাকিয়ে ছিলো রিদির দিকে। মেয়েটার কপালের সামনের চুলগুলো ওড়নার ফাঁক থেকে বের হয়ে এসেছে। হালকা বাতাসে চুলগুলো নড়ে উঠছে, রিদির মুখটায় যেন এক ধরনের নিষ্পাপ সৌন্দর্য আরও ফুটে উঠেছে।
হঠাৎ রিদির নাকে এসে লাগলো একগুচ্ছ ফুলের তীব্র ঘ্রাণ। সে ভ্রু কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পিছনের দিকে। পাশেই ফুলের গাছগুলোতে ফুটে আছে সাদা বেলি ফুল। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে রিদি হাত বুলিয়ে দিলো ফুলের পাপড়িতে। চোখ বন্ধ করে নাকটা কাছে নিয়ে গিয়ে শুঁকল। তীব্র সুবাসে তার বুকটা যেন ভরে গেলো।
তামিম দূর থেকে একমনে তাকিয়ে রইলো সেই দৃশ্যের দিকে। কিছুক্ষণ দ্বিধা কাটিয়ে সে এগিয়ে গিয়ে বসল রিদির একটু পাশে, উল্টো দিকের ধাপে।
“তুমি ফুল পছন্দ করো?”
রিদি মুখে ছোট্ট একচিলতে হাসি এনে উত্তর দিলো,
“ফুল কে পছন্দ না করে।”
“তোমার, কোন ফুল বেশি পছন্দ?”
“ফুল বলতে সবই আমার পছন্দ। ফুল তো সবই সুন্দর!”
তামিম ঠোঁটে একরাশ হাসি আনলো। মনে মনে নিজেকে বললো,
“তুমি ফুলের চেয়েও সুন্দর… ভয়ংকর সুন্দর।”
রিদি তার মুখের ভঙ্গি খেয়াল করলো। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“হাসছো কেন? আমি হাসার কথা বলেছি কিছু?”
“না না, তার জন্য না।”
“তাহলে.?”
“এমনিই একটা কথা মনে পড়লো তাই।”
“ওহহ।”
তারপর দু’জনেই চুপ করে গেলো। এরই মাঝে আনিকা, আহিয়া আর নীলা উঠে দাঁড়ালো। তারা ফুচকা খাওয়ার প্ল্যান করছে। আনিকা ডেকে উঠলো,
“রিদি আয়, ফুচকা খেয়ে আসি।”
রিদি মুখ ভার করেই উত্তর দিলো,
“আমার ভালো লাগছে না। তোরা যা।”
আনিকারা একে অপরের দিকে তাকালো। তারা জানে, রিদি এমনটাই বলবে। কিন্তু তাকে তো আর একা মন খারাপ করে বসে থাকতে দেয়া যায় না। আনিকা আর আহিয়া একসাথে গিয়ে রিদিকে দুই পাশ থেকে বাহু জড়িয়ে ধরে টেনে তুললো,
“তুই যাবি না, তোর দাদা যাবে। চল!”
রিদি কয়েকবার মানা করলো, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো ওদের সাথে। তাদের হাসি-ঠাট্টার শব্দ মিলিয়ে গেলো দূরে। সিঁড়িতে বসে রইলো কেবল তামিম আর সাব্বির। তামিমের চোখ এখনো গেটের দিকে, যেখানে একটু আগেই রিদি বেরিয়ে গেলো। তার দৃষ্টি সরছে না। সাব্বির একগাল হেসে তামিমের ঘাড়ে হাত রাখলো,
“মামা, আর কতদিন এভাবে তাকিয়ে থাকবি? এবার প্রপোজ করে দিলেই তো পারছিস।”
তামিম হালকা হাসলো, তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভয় হয়। যদি বন্ধুত্বটাই শেষ হয়ে যায়।”
“আরে দূর! যারে ভালোবাসছিস, তার সাথে আবার কিসের বন্ধুত্ব? বলে দিলে একটা না একটা কিছু তো হবেই।”
তামিম চুপ করে গেলো। মনে মনে কিছু ভেবে আবার গেটের দিকে তাকালো। রিদির ছাঁয়াও আর নেই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“দেখি…”
সাব্বির এবার গম্ভীর সুরে বললো,
“দেখি আবার কি! শোন, কয়েকদিন পরেই তো আমাদের ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান আছে। আমি বলি কি, তখনই প্রপোজ করে দে।”
তামিম এবার আর কিছু বললো না। শুধু একটু নড়ে চড়ে বসল। ভেতরে ভেতরে তার বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা কাঁপুনি বাজতে লাগলো।
ভার্সিটির মূল গেটের একপাশে বসে থাকে সেই চিরচেনা ফুচকা ওয়ালা মামা। এতদিন ধরে যেন তাদের এক আড্ডার জায়গা হয়ে গেছে এই ফুচকার দোকানটা। প্রায়ই ক্লাস শেষে এসে এখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা আর ফুচকা খাওয়া হয়। আজও তারা তাই করলো। কিন্তু আজ মামা নেই, তার জায়গায় বসেছে বারো-তেরো বছরের এক কাঁচা বয়সী ছেলে। মামার জায়গায় বসে ব্যবসা সামলাতে চেষ্টা করছে। চারপাশে ইতোমধ্যে কিছু ছেলে-মেয়ে ভিড় করেছে। তারা গিয়ে অর্ডার দিল চার প্লেট ফুচকার। রিদি গম্ভীর গলায় বলল,
“আমারটা ঝাল ছাড়া।”
আনিকা তাকিয়ে বলল,
“জানি ! সেদিন সামান্য একটু ঝাল খেয়ে যা করলি!”
এরপর তারা একপাশে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগল। তবে রিদি আবারও চুপচাপ। মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। আনিকা কয়েকবার তাকিয়ে দেখল, তারপর বিরক্ত হয়ে বলল,
“কি সমস্যা তোর? কি হইছে?”
“কিছু না। এমনই, ভাল্লাগে না।”
নীলা কপাল ভাজ করে বলে উঠল,
“তিন বেলা প্যারাসিটামল খা, তোর এই "ভাল্লাগে না" শুনতে আমাদেরও আর ভালো লাগে না।”
রিদি ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে রইল। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যায়, ভেতরে কিছু একটা গুমরে মরছে, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। তারা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে অথচ ফুচকার প্লেট একটাও আসছে না। আহিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
“উফফ! আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো? এখনো দিচ্ছে না কেনো?”
সবাই একসাথে ছেলেটার দিকে তাকালো। নীলা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“এই যে বাবু, আর কতক্ষণ?”
“আফা, মামায় বাইরে গেছে একটু। আমি তো চেষ্টা করতাছি দিতে, কিন্তু সময় লাগবো আফা।”
রিদিতা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আমাদেরটা আমরা নিজেরাই বানিয়ে নিলে হবে?”
ছেলেটা হকচকিয়ে তাকিয়ে বলল,
“পারলে নেন।”
বলতেই রিদি আর দেরি না করে ছেলেটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কৌতূহলী চোখে সব উপকরণ দেখল, তারপর হাত লাগালো বানাতে। ছেলেটা একটু একটু করে সব দেখিয়ে দিচ্ছে, আর রিদিতা আলতো হাতে ফুচকা বানাচ্ছে। বন্ধুরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এই দৃশ্য দেখে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা রিদি যেন একেবারে অন্য রূপে হাজির হলো। গম্ভীর, মন খারাপ করা মুখের বদলে তার চোখেমুখে এখন অন্যরকম এক মনোযোগ।
তখনই আহাদ রাজার চকচকে কালো গাড়িগুলে এসে থামল গেটের পাশে। গাড়ি থেকে নামে আহাদ চারপাশে একবার তাকাল। আহিয়াদের দিকে দৃষ্টি যেতেই আহাদ প্রথমে সাধারণ ভঙ্গিতে এগোচ্ছিল, কিন্তু পরের দৃশ্যটা দেখে তার মুখ শক্ত হয়ে গেল। এক মূহুর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর ঠোঁটে অদ্ভুত বাঁক এনে ব্যঙ্গাত্মক এক হাসি দিল। রিদিকে শাস্তি দিতে গেট থেকে আসা সকল ছাত্র ছাত্রীদেরকে ডেকে, অদ্ভুত ভঙ্গি করে হাত নেড়ে বলে,
“এদিকে শুনো সবাই, তোমাদের জন্য ফ্রি ফুচকার অফার আছে। যাও যাও... ফ্রি ফুচকা খেয়ে আসো। সবাই যাও! যাও! যাও!”
মুহূর্তেই ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় জমে গেল। ভিড় দেখে রিদি স্তব্ধ হয়ে গেল। সবে সে বানিয়ে দিয়েছিল আহিয়া আর নীলার প্লেট, এখন চারপাশ থেকে হাত এগিয়ে আসছে।
ছোট্ট ছেলেটা একেবারে দিশেহারা হয়ে তার দিকে তাকাল। চোখে অসহায়তা। রিদির খুব মায়া হলো। এক ঢোক গিলে আবার হাত লাগালো। একের পর এক বানিয়ে দিতে লাগল ছেলেটার সাহায্য নিয়ে। কিন্তু ভিড় সামলাতে গিয়ে তার হাত কাঁপছে, হাঁপিয়ে উঠেছে। বোঝা যাচ্ছে, আরেকটু হলেই হয়তো কেঁদে ফেলবে।
আহাদ গাড়ির বনেটে হেলান দিয়ে পকেটে হাত রেখে দাঁড়াল। চোখে কালো চশমা, তার ঠোঁট থেকে বের হলো কটাক্ষভরা স্বর,
“আহা! কি দৃশ্য! আহাদ রাজা মীরের প্রেয়সী হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা বানাচ্ছে! বাহ! চমৎকার!”
সেই ভিড় লক্ষ করে আহাদ শাহীনকে ঠোঁট বাঁকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
“বুঝলি শাহীন, বাঙালি জাতি বড়ই অদ্ভুত। ফ্রি তে বিষ দিলেও, নিতে লাইন ধরবো।”
“ঠিক বলছেন ভাই।”
এক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে আহাদ। যখন দেখলো রিদি আর সামাল দিতে পারছে না, হাঁপিয়ে উঠেছে। তখন ভাবলো, সে যেটা চেয়েছে হয়েছে। এরপর গটগট শব্দ করে এগিয়ে এলো আহাদ। রিদির হাতে থাকা ফুচকার প্লেট কারও দিকে দেবার আগেই, সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে।
মূহুর্তেই রিদির বুক ধপ করে উঠল। আহিয়া, নীলা আর আনিকা তিনজনেই স্তব্ধ। আহাদের চোখ এখন লাল হয়ে উঠেছে, ক্রোধে টগবগ করছে। সেই দৃষ্টি বিদ্ধ করছে সরাসরি রিদিকে। রিদি একটা শুকনো ঢোক গিলে ফেলল। হাতে ধরা প্লেট যেন ভারী হয়ে উঠেছে হঠাৎ। চারপাশের সব শব্দ মিলিয়ে গিয়ে শুধু আহাদের চোখ আর তার নিজের দ্রুত নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে।

No comments:

720

Powered by Blogger.