#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী
ভার্সিটির দিনটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। করিডোরগুলোতে এখন আর তেমন ভিড় নেই, ছাত্রছাত্রীরা ইতোমধ্যে বাসায় ফিরছে। চারদিকে এক অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ। কিন্তু সেই শান্ত পরিবেশের মাঝেই কমন রুমের ভেতরে যেন চাপা ঝড় বইছে। কমন রুমে ঢুকলেই বোঝা যায়, ভেতরে কেমন গুমোট ভাব। দরজা বাইরে থেকে গার্ডরা পাহারা দিচ্ছে। জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকা আলোয় রুমটা আধো অন্ধকার, আর মাঝখানে কাঠের একটা বেঞ্চের উপরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে চারজন মেয়ে রিদিতা, আনিকা, আহিয়া আর নীলা। যেন বিচারাধীন আসামি।
অন্যদিকে দাঁড়িয়ে আছে আহাদ রাজা মীর। হাত দুটো বুকের কাছে শক্ত করে ভাজ করে রেখেছে। চোখে জ্বলন্ত দৃষ্টি, চোয়াল কষে ধরা, রাগে তার মুখমণ্ডল কাঠের মতো শক্ত হয়ে আছে। শাহীন, নাদিম আর শাওন তারা তিনজন এক পাশে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন আগেই জানে কী হতে চলেছে। প্রিন্সিপালও কিছু বলার সাহস পায়নি। আহাদ রাজা মীর ভার্সিটিতে আসার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সেই বিল্ডিং প্রায় খালি করে দিয়েছে প্রশাসন।
আহাদ ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। এক এক করে চারজন মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, যেন প্রত্যেককে আলাদা করে মাপছে। তার জ্বলন্ত চোখের সামনে কেউ মুখ তুলতে সাহস পাচ্ছে না। প্রথমে রিদির সামনে এসে দাঁড়াল। এক মুহূর্তের জন্য তার দৃষ্টি থমকে গেল। কিন্তু কিছু না বলে মাথা একটু ঝাঁকিয়ে চলে গেল আহিয়ার সামনে। কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর আনিকা, তারপর নীলা। সবার মাথাই নিচু। হঠাৎ কাঠের মতো শক্ত গলায় বলে উঠল আহাদ,
“মাইন্ড ব্লোয়িং! ফ্যান্টাস্টিক!”
কণ্ঠে প্রচণ্ড ব্যঙ্গ।
“মীর পরিবারের নাম জড়িয়ে আজ রাস্তায় ফুচকার ব্যবসা পাতিয়ে বসেছে। ইন্টারেস্টিং… ভেরি ইন্টারেস্টিং!”
বলেই হাততালি দিল জোরে। তীক্ষ্ণ শব্দে চারজন মেয়েই আরও মাথা নিচু করে ফেলল। চারপাশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। আহাদ হঠাৎ গর্জে উঠল,
“এখন তোদের কী শাস্তি দেয়া উচিত, বলো তো!”
কেউ মুখ খুলল না। সবাই ভয়ে মাথা আরও নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আহাদ এবার ধীরে ধীরে গিয়ে এক টেবিলের উপর লাফ দিয়ে উঠে দু’পা ঝুলিয়ে বসল, চোখে জ্বলন্ত আগুন। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ঠাণ্ডা অথচ কঠিন সুরে বলল,
“কান ধর।”
তার কথায় রিদি বাদে বাকিরা হকচকিয়ে মাথা তুলল। আহাদ কি সত্যিই বলল? এই বয়সে কান ধরতে হবে তাদের? কিন্তু সে আবার গর্জে উঠল,
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শুনতে পাসনি, ডু ইট!”
তাদের চোখেমুখে লজ্জা, ভয়, অপমান সব মিলেমিশে অস্থির অবস্থা। তবুও শেষমেশ তিনজন দ্রুত কান ধরল।
সবাই ভাবলো রিদি হয়তো প্রতিবাদ করবে, কিন্তু অবাক কাণ্ড। সে একটুও দেরি করল না। মাথা নিচু করে সেও কান ধরল। এমন ভঙ্গিতে যেন এর আগে বহুবার এমনটা করেছে। আনিকা, আহিয়া আর নীলা চোখ কপালে তুলে একসাথে তাকালো রিদির দিকে। মুখ চাওয়াচাওয়ি করল এটা কি সত্যি ঘটছে?
এমনকি আহাদও খানিকটা অবাক হলো। ভেতরে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। চোখ আটকে গেল রিদির দিকে। মাথা নিচু, কান ধরা, নিঃশব্দ কিন্তু মুখে এক অদ্ভুত সরলতা। বুকের ভেতর হঠাৎ করে একটা মোচড় খেল সে। তবুও কণ্ঠ রুক্ষ করে বলল আহাদ,
“বিশ বার কান ধরে উঠবস করবি। একটাও যেন কম না হয়। কুইক!”
বলতেই রিদিতা উঠবস শুরু করল। মাথা নিচু, শরীর নিস্তেজ, কিন্তু তবুও অনায়াসে আদেশ পালন করছে।
তাকে উঠবস করতে দেখে বাকিদের চোখ আরও বিস্ফারিত হয়ে গেল। আনিকা-আহিয়া-নীলা হতবাক হয়ে রিদিকে দেখছে। যেন ভাবছে, ও কি সত্যিই করছে?
আহাদের বুক কেমন অদ্ভুত কেঁপে উঠল। তার রাগ হঠাৎ কিছুটা থেমে গেল। চাপা যন্ত্রণার মতো কিছু অনুভব করতেই, সে বুকের ওপর হাত চেপে ধরল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল। রিদি বিশ বার শেষ করে আবার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে, কিন্তু মুখে একটুও প্রতিবাদ নেই। আহাদ এবার নরম কণ্ঠে বলল,
“নেমে এসো।”
রিদি চুপচাপ নেমে এলো। কিন্তু আহিয়া একটু নড়তেই হঠাৎ বজ্রকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল আহাদ,
“তোদের নামতে বলেছি? আমার কথা অমান্য করেছিস! তোদের শাস্তি দ্বিগুণ করে দেয়া হলো, চল্লিশ বার!”
শাহীন, নাদিম, শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একবারও যেন কম না হয়। গুনে রাখবি। না হলে আরও বাড়িয়ে দিবি!”
অতঃপর কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই রিদির হাত শক্ত করে ধরে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। পেছনে রইলো অসহায় তিনজন মেয়ে। তারা একে অপরের দিকে তাকালো, চোখেমুখে আতঙ্ক। শেষমেশ মেনে নিয়ে কান ধরে উঠবস শুরু করল। আর তা দেখে পাশে দাঁড়িয়ে শাহীন, নাদিম আর শাওন মুখ টিপে হাসতে লাগল। দৃশ্যটা যেন তাদের কাছে বিনোদন ছাড়া কিছুই নয়।
★
বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশ ঘেঁষে গাড়ি এসে দাঁড়ালো একটা লেকের সামনে। চারদিকের বাতাসে এক ধরনের স্নিগ্ধতা, অথচ গাড়ির ভেতরটা গুমোট নীরবতায় ভরে আছে। রোদের আলো লেকের পানিতে চিকচিক করে পড়ছে, সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে জানালার কাঁচে এসে পড়ল। হঠাৎ আলোটা রিদির চোখে লাগতেই সে ভ্রু কুঁচকে নিলো, ঠোঁট শক্ত হয়ে গেলো। চোখেমুখের সেই সামান্য অস্বস্তিও এড়িয়ে যায়নি আহাদের দৃষ্টি।
আহাদ তার চোখের সানগ্লাস খুলে ধীরে ধীরে তাকাল রিদির দিকে। সাধারণত তার দৃষ্টিতে সবসময় তীক্ষ্ণতা আর দৃঢ়তা লুকিয়ে থাকে, কিন্তু আজ সেখানে অদ্ভুত এক শূন্যতা। সে চুপচাপ রিদির মুখ দেখতে লাগল। আজকের রিদি অন্যদিনের মতো নয়। নাহ কোনো প্রতিবাদ, না কোনো রাগ, এমনকি একটুখানি হাসিও নেই তার মুখে। পুরোপুরি গম্ভীর, যেন প্রাণহীন। এমন রিদিকে দেখে মনে হলো আহাদের বুকের ভেতর যেন কেউ পাথর ছুঁড়ে মারলো। এক অদ্ভুত চাপা যন্ত্রণা বুক চেপে ধরল। সে গলা শুকিয়ে আসা ঢাকতে একবার ঢোক গিলে নিলো।
ড্যাশবোর্ড থেকে একটা পানির বোতল টেনে নিয়ে ঢাকনা খুলে রিদির দিকে বাড়িয়ে দিলো। কোনো ভণিতা না করে হাত বাড়িয়ে দিলো রিদি। তার দিকে না তাকিয়ে নিঃশব্দে বোতলটা হাতে নিলো। ঠোঁটে ছুঁইয়ে একটানা এমনভাবে খেতে লাগল যেন কয়েক যুগ ধরে সে পানি পায়নি। এক চুমুকে অর্ধেক বোতল শেষ করে ফেলল। আবার না তাকিয়েই বোতলটা আহাদের হাতে ফিরিয়ে দিলো।
আহাদ এক মুহূর্ত সেই স্পর্শকাতর বোতলটা দেখতে লাগলো। তারপর নিজের ঠোঁটে সামান্য চেপে একচুমুকে নিজেই বাকি অর্ধেক শেষ করে ফেলল। বোতলটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নাকটা ঘষে নিলো। রিদির দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
“এই আল্লাহর বান্দি এই, তাকাও আমার দিকে।”
রিদি সরাসরি সামনে তাকিয়ে আছে। যেনো এই পৃথিবীতে কিছুই নেই, শুধু সামনের পানির ঢেউ দেখছে। তার পলকও পড়ছে না। আহাদের ভেতরটা হঠাৎ জ্বলে উঠল। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো,
“আমি আমার দিকে তাকাতে বলেছি, রিদি!”
রিদি একবার গলার ভেতর শুকনো ঢোক গিলে ফেলল। অতঃপর ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে আহাদের দিকে তাকাল। সোজা চোখে চোখ রেখে দিলো তার দৃষ্টি। সেই চোখে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা আর এক অজানা ক্লান্তি। আহাদ অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর ঠাণ্ডা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে, হুম?”
রিদি কোনো ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই ফিসফিস করে বলল,
“কিছু না।”
“তাহলে এমন চুপ হয়ে আছো কেনো?”
রিদি দৃষ্টি সরিয়ে জানালার বাইরের দিকে তাকাল। ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
“এমনই।”
আহাদের বুকে মনে হলো হাতুড়ি দিয়ে কেউ পেরেক গাঁথছে। তবু ঠোঁটের কোণে শক্তি জমল। কণ্ঠে সামান্য রাগ মিশে গেল,
“আল্লাহর দুনিয়ায় "এমনই" বলে কিছু নেই। এমনইর ও একটা কারন থাকে। কি হয়েছে সেটা বলো।”
রিদি তবুও চুপ। কোনো উত্তর দিলো না। শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল, রাস্তার গাছপালার ভেতর দিয়ে হাওয়া বইছে। তার চোখে এক ধরনের শূন্যতা। আহাদ ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। আমি কি খুব বেশি রূঢ় হয়ে গেলাম? একটু বেশিই রুড বিহেভ করেছি? নাকি আসলেই ওর ভেতরে অন্য কোনো কারণ আছে? অতঃপর গভীর নিঃশ্বাস ফেলে একটু নরম কণ্ঠে বলল,
“বাসায় যাবে?”
রিদি ধীর স্বরে উত্তর দিলো,
“হুম।”
আহাদ এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি মোড় নিলো রিদির বাসার রাস্তার দিকে। গাড়ির ভেতরে আবারো নেমে এলো নিঃশব্দতা। শুধু ইঞ্জিনের শব্দ আর বাইরের বাতাসের সোঁ সোঁ ধ্বনি। মাঝেমধ্যে আড়চোখে আহাদের দিকে তাকিয়ে দেখে, হয়ত কিছু ভাবে। কিন্তু আহাদ তাকাতেই সে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, যেন কিছুই হয়নি।
আহাদ সব বুঝতে পারছে, তবু কিছু বললো না। শুধু ভেতরে ভেতরে বুকের ভেতরটা চেপে আসছে তার। তার প্রেয়সীর এমন রুপ যে তার প্রথম দেখা!
★
মীর হাউজের বিরাট ডাইনিং টেবিলটা সব সময়ের মত যথারীতি সাজানো, টেবিলের মাঝখানে কাঁচের ফুলদানি ভরে রাখা তাজা গোলাপ আর লিলির মিশ্র তোড়া। সময় তখন রাত প্রায় পনে এগারোটা। আলোকসজ্জা যেন খুবই মৃদু, হালকা হলুদ আলোয় পুরো ঘরটা আভিজাত্যের সাথে গম্ভীরতায় ভরে উঠেছে। চারদিক শান্ত, শুধু শোনা যাচ্ছে চামচ-কাঁটার টুংটাং শব্দ, সেটাও যেন নিস্তব্ধতাকে আরো ভারী করে তুলছে।
আফরোজা শেখ ধীরে ধীরে কাঁটাচামচ চালাতে চালাতে একবার আদনানের দিকে তাকালেন। আদনান মাথা নিচু করে খেতে ব্যস্ত। আবার চোখ নামিয়ে আনলেন নিজের প্লেটে। আসফাক মীর পাশ থেকে হালিমাকে উদ্দেশ করে গম্ভীর গলায় বললেন,
“তুমিও বসো না হালিমা, দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
“হ্যাঁ, এইতো বসছি।”
হালিমা বেগম ধীর পদক্ষেপে এসে পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে বসলেন। রান্নাঘর থেকে পরিচারিকা বানু আর রিতু পরপর খাবার এনে সাজিয়ে রাখছে। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। ঠিক তখনই সিড়ি বেয়ে নামলো আহাদ। ধীরে ধীরে টেবিলের একপাশে গিয়ে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ার টেনে বসল। তার পায়ের শব্দে যেন টেবিলের চারপাশে শীতল হাওয়া বইতে লাগলো। চুপচাপ বসে থাকা সবাই এক মুহূর্তের জন্য তাকালো তার দিকে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলো আহিয়া। আহাদকে দেখেই তার গলাতে খাবার আটকে গেলো। হঠাৎ হেচকি উঠে গেলো। আজকের ঘটনাটা মনে পরতেই ভয়ে একের পর এক হেচকি উঠছে তার। আদনান দ্রুত উঠে এসে আলতো করে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো,
“ধীরেধীরে শ্বাস নে, রিলেক্স! সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু এতে উল্টো আরো বেড়ে গেলো। আহিয়ার মুখ লাল হয়ে উঠেছে আদনানের স্পর্শে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আফরোজা শেখ বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
“খাওয়ার সময় মন কোথায় থাকে? এখন পর্যন্ত খাবারটা ও ঠিকঠাক খেতে পারো না।”
আদনান দু আঙুল দিয়ে নাক চেপে ধরে বলে,
“মুখ দিয়ে নিশ্বাষ নে।”
কয়েক বার ঘন ঘন নিশ্বাষ নিলো আহিয়া। আদনান জিজ্ঞেস করল,
“এখন ঠিক আছিস?”
আহিয়া আবার একটা হেচকি দিয়ে মাথা নাড়ে, অর্থাৎ সে ঠিক নেই। পরপর কয়েক বার হেচকি দিতেই আহাদ হঠাৎ গম্ভীর স্বরে, ঠাণ্ডা দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বলল,
“একটা থাপ্পড় খেলে অটোমেটিকালি তোর হেচকি বন্ধ হয়ে যাবে।”
তার ঠাণ্ডা অথচ কেটে যাওয়া কণ্ঠে টেবিলের পরিবেশ হিম হয়ে গেলো। আহিয়ার চোখ বিস্ফারিত হয়ে তাকিয়ে রইল আহাদের দিকে। সেই ভয়ের মধ্যেই হঠাৎ তার হেচকি সত্যিই থেমে গেলো। আদনান এবার বিরক্ত আর রাগে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাকালো আহাদের দিকে। অতঃপর হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি তুলে এনে আহিয়ার সামনে ধরলো।
“পানি টা খেয়ে নে।”
আহিয়া তাকিয়ে রইলো শুধু গ্লাসটার দিকে, যেন স্পর্শ করার সাহস পাচ্ছে না। আদনানের কণ্ঠ এবার মোলায়েম হয়ে এলো,
“তাকিয়ে আছিস কেনো? ধর গ্লাসটা।”
দ্রুত হাত বাড়িয়ে আহিয়া গ্লাসটা নিয়ে, এক নিঃশ্বাসে পানি খেয়ে নিলো। তার বুক ওঠানামা করছে, চোখ ভিজে গেছে। তবে এখন একটু স্বাভাবিক। আদনান ধীরে ধীরে বসে পড়লো নিজের চেয়ারে। বিরক্তি চোখ রেখে তাকিয়ে আছে আহাদের দিকে। দুই ভাইয়ের মধ্যে নীরব রেষারেষি, টেবিলের প্রতিটি মানুষ সেটা টের পেলো। আবার নিস্তব্ধতা নেমে এলো চারদিকে। হঠাৎ আহিয়ার দিকে একবার তাকাল আহাদ। কিছু একটা ভেবে আহাদ খাবার রেখে, শরীরটা আসফাক মীরের দিকে ঘুরালো। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। আঙুল দিয়ে চিবুক ঘষতে ঘষতে সে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
“চাচু! আমাকে দেখতে কি ভয়ংকর লাগে?”
তার হঠাৎ এই উদ্ভট প্রশ্নে সবাই থমকে তাকালো। চামচের শব্দও থেমে গেলো। হালিমা বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, আফরোজা শেখ ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। আসফাক মীর ধীর গলায় কটাক্ষ করে উত্তর দিলেন,
“না, সোলাইমান শাহ পীর সাহেব আউলিয়া আব্দুল গাজীর নাতির মতো লাগে।”
কথাটা শুনে আদিল, আহিয়া মুখে হাত দিয়ে হালকা হেসে ফেললো। কিন্তু আহাদ সিরিয়াস ভঙ্গিতে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
“সেটা আবার কে?”
আসফাক মীর ঠোঁট উল্টে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন,
“আমি কি জানি?”
বলেই হালকা বিদ্রূপের হাসি ছুড়ে দিলেন। আহাদ এবার চোখমুখ শক্ত করে গর্জে উঠলো,
“ফান করতেছো আমার সাথে?”
“একদমই না! আমি সিরিয়াস।”
“চাচুুউউ..!”
গর্জে উঠে এক ঝটকায় চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো। টেবিল কেঁপে উঠলো তার ভরকেন্দ্রের শক্তিতে। গটগট করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো, শব্দে পুরো হলঘর গমগম করে উঠলো। হঠাৎ আমজাদ মীর খাওয়া থামিয়ে মুখ মুছলেন। অতঃপর সবাইকে শুনিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
“হাহ..! আচরণ করবে হায়েনার মতো, আর তার চেহারা হবে মাছরাঙার মতো!”
কথাটা শুনে সবাই হালকা হেসে ফেললো। তবে আদনানের মুখের ভঙ্গি একটুও বদলায়নি। সে নিজের মত চুপচাপ খেতে ব্যাস্ত। আড় চোখে একবার আফরোজা শেখের দিকে তাকাতেই চোখা চোখি হলো। নজড় ফিরিয়ে আবার খাবারে মনযোগ দিলো।
★
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত তিনটার কাছাকাছি। বাইরের দুনিয়া নিস্তব্ধ, চারপাশে যেন অচেনা শূন্যতার ভার। মাঝে মাঝে শুধু ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ কানে আসছে, আর দূরের কোথাও কুকুরের ডেকে ওঠা সেই নিস্তব্ধতাকে ভেদ করছে। রিদিতার চোখে ঘুম নেই। বারবার চেষ্টার পরও চোখের পাতা এক হচ্ছিল না। মনের ভেতর অদ্ভুত এক অস্থিরতা। আজকের দিনের ঘটনাগুলো বারবার মাথায় ভেসে উঠছে। সে চেয়েছিল আজ যেন কোনো বিপত্তি না ঘটে, কোন তামাশা না হয়। কিন্তু ভাগ্য? সে আবারো অঘটন ঘটিয়ে ফেললো। তার জন্য শুধু সে নয়, তার বান্ধবীরাও শাস্তি পেল। এই এক অপরাধবোধে রিদিতার বুকটা কেমন করে উঠছে।
সে পাশে রাখা ফোনটা তুলে নিলো। সারা সন্ধ্যা থেকেই ফোন বন্ধ ছিল। এটা তার পুরোনো অভ্যাস, মন খারাপ হলে সে নিজের সাথে নিজের পৃথিবীতে ডুবে যায়, বাইরের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখতে চায় না। ফোনের স্ক্রিন অন করতেই ফ্ল্যাশলাইটের আলোতে ঘরটা ম্লান হয়ে উঠলো।
ফেসবুকে ডুকেই আহাদ রাজার একটা ছবি বেড় করলো। অফ হোয়াইট স্যুট পরা, কালো গাড়ির পাশে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেলে দাঁড়িয়ে আছে সে। ছবির দৃষ্টি যেন কেটে ঢুকে যাচ্ছে তার হৃদয়ে। রিদি শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো সেই ছবিটার দিকে। এটা রিদির পছন্দের একটা ছবি, যেটা সে মাঝেমাঝেই বেড় করে দেখে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে আঙুল বুলিয়ে হঠাৎ মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
“কেন শুধু আপনাকেই আঁকড়ে ধরলো মন আমার?
এ বিশাল দুনিয়ায় কি আর কোনো পুরুষ ছিল না?
নিজের বোনা জালে নিজেই ফেঁসে গেলাম আমি। যেখান থেকে চাইলেও আর বেড় হতে পারব না। আর না আমি চাইব।
তার বুক ভারি হয়ে গেলো। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ফোনটা বুকের উপর রেখে হাত-পা ছড়িয়ে দিলো। দু চোখের পাতা বন্ধ করতেই বুকের উপর রাখা ফোনটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো। চমকে উঠে রিদিতা। ফোন হাতে নিতেই দেখে স্ক্রিনে ভেসে উঠলো আহাদের নাম্বার। রিদির বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। হঠাৎ আহাদের কল, তাও আবার রাত তিনটায়! একরাশ ভাবনা মাথায় ঝড় তুললো। কাঁপা-কাঁপা আঙুলে রিসিভ করে ফোন কানে চেপে ধরলো, কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। রিদির কণ্ঠ মোলায়েম, প্রায় ফিসফিসের মতো।
“হ্যালো…”
চুপ, ওপাশ থেকে কোনো উত্তর নেই। রিদি আবার বললো, একটু বেশি দৃঢ়তার সাথে,
“হ্যালো… আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?”
অবশেষে ওপাশ থেকে আধো মাতাল কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হুমম…”
মাত্র ছোট্ট একটা শব্দ। কিন্তু সেই শব্দটাই যেন রিদির বুকের উপর ভারি কোনো পাথর ছুড়ে দিলো। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
“তাহলে কিছু বলছেন না কেনো?”
কোনো উত্তর এলো না, আবারও নীরবতা। রিদির কণ্ঠ এবার কেঁপে উঠলো,
“যদি কথাই না বলবেন, তাহলে ফোন করলেন কেনো?”
অন্যপ্রান্ত থেকে আবারো সেই মাতাল কণ্ঠ এলো,
“আমার ইচ্ছে।”
রিদির বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। তার মাথায় ঝট করে বোধোদয় হলো। এই কণ্ঠস্বর… এভাবে টলমল শব্দ… আহাদ নিশ্চয়ই ড্রিংক করেছে। সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সে একটু কপাল কুচঁকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি… আপনি এখন কোথায়?”
ওপাশ থেকে হালকা হাসি মিশ্রিত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আপনার বাসার নিচে।”
রিদি যেন বজ্রাহত হলো। ধড়ফড় করে উঠে বসল।
“কিহহ! এতো রাতে এখানে কি করছেন?”
কোনো উত্তর এলো না। সে আরো কয়েকবার প্রশ্ন করলো, কিন্তু ওপাশ থেকে নিস্তব্ধতা। অবশেষে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“ঠিক আছে। আপনি থাকুন, আমি আসছি।”
ফোনটা রেখে দিলো। ওপাশে আহাদ শুধু নিঃশব্দে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। রিদি দ্রুত গায়ে ওড়না জড়িয়ে, পা টিপে টিপে আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। চারপাশ নিস্তব্ধ, যেন পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে। নিচে নামতেই দেখতে পেলো গাড়ির সাথে হেলে দাঁড়িয়ে আছে আহাদ। হাত দুটো বুকে ভাজ করা, চোখ ম্লান আলোয় ঝলসে উঠছে। রিদি ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়ে এলো। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে, কিন্তু সে মুখ শক্ত রাখলো। কাছে এসে চারপাশে একবার তাকালো। সবকিছু অচল, যেন থেমে গেছে। আর একটু কাছে গিয়ে নিচু গলায় প্রশ্ন করলো,
“আপনি ড্রিংক করেছেন?”
আহাদ তার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। শুধু হাতঘড়ির দিকে তাকালো। চোখ না সরিয়েই গম্ভীর স্বরে বললো,
“সাত মিনিট লেট।”
“তো.!”
“সাত বার কান ধরে উঠবস করো।”
রিদির মুহূর্তেই দাঁতে দাঁত চেপে গেলো। কটমট করে তাকালো আহাদের দিকে। আহাদ আধো মাতাল কণ্ঠে হাসলো,
“কি হলো? আমি কিছু বলেছি তো নাকি?”
রিদির চোখ জ্বলে উঠলো,
“আমিও তো কিছু জিজ্ঞেস করেছি।”
আহাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কি?”
“এত রাতে এখানে এসেছেন কেনো?”
আহাদ হালকা ঘাড় কাত করলো, এক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে বা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নাক ঘষলো। ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপ টেনে বললো,
“এমনিই।”
রিদি এবার দাঁতে দাঁত চেপে চোখ সরু করে বললো,
“আল্লাহর দুনিয়ায় এমনিই বলতে কিছু হয় না। এমনই এরও একটা কারণ থাকে।”
আহাদ দমকা হেসে উঠে বললো,
“আমার ডায়লগ আমাকেই ফেরত দিচ্ছো?”
“হ্যাঁ, দিচ্ছি।”
আহাদ চোখ কুঁচকে আবারও মাতাল কন্ঠে ফিসফিস করে বললো,
“থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো। আহাদ রাজার মুখের উপর কথা।”
রিদি স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নেশা করে অর্ধেক পাগল হয়ে আছে, অথচ কাথার ঝাঁঝ কমেনি। রিদি ঠাণ্ডা গলায় বললো,
“আমার এখানে আসাই ভুল হয়েছে।”
বলেই ঘুরে চলে যেতে নিতেই, আহাদ তার হাতটা টেনে ধরে। এক মূহুর্ত থমকে যায় রিদি, বুকটা ধড়াস করে উঠে। আহাদ একটু ঝুঁকে তার কানের কাছে এসে নেশালো কন্ঠে ফিসফিস করে বলে,
“ভুল যখন করেছিস এর শাস্তিটা ও নিয়ে যা, জা নু..!”
“ক.. কি শাস্তি!”
আহাদ সরাসরি তার চোখে দৃষ্টি মিলিয়ে হালকা হাসলো, তার সেই হাসিতেই যেনো উওর লুকিয়ে ছিলো। রিদি চোখ বড় বড় করে বলে,
“না, মোটেও না।”
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো। আহাদ তার চলে যাওয়া পায়ের শব্দের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে ফেললো। আবার গাড়ির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা উঁচু করে ছয়তলার বারান্দার দিকে তাকালো। চোখে ভাসলো রিদির অবয়ব, ঠোঁটে ঝুললো আধো মাতাল সেই হাসি। রাতের আকাশ তখনো চুপচাপ তাকিয়ে আছে, যেনো শুধু তাদের দিকে।
No comments: