Header Ads Widget

test

#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী (পর্ব) 13

 


#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী 


হালিমা বেগমের ডাকে ঘুম ভাঙলো আহিয়ার। আজকে তো তার কোনো ভার্সিটি নেই, তাই তো ঘুমের রাজ্যে ডুবে ছিল। কিন্তু কয়েকবার ডাকার পরও না ওঠায়, এবার কড়া গলায় হালিমা বেগমের স্বর ভেসে এলো উপরে। আহিয়া ঘুম জড়ানো চোখে হাত পা ছুড়ে, মুখে হাই তুলতে তুলতে আধো-বসা অবস্থায় উঠলো। ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া রোদে বোঝা যায় বেলা অনেক গড়িয়েছে। তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গাল বেয়ে নেমে এসেছে, চোখের পাতায় এখনো ঘুমের ভার। কয়েকবার মুখ চাপড়ে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো।
দুলতে দুলতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো, আর গিয়েই ধপ করে সোফার উপর বুঁদ হয়ে পড়লো। আবারো চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল, শরীরের ভেতর অলসতা যেনো তাকে চেপে ধরেছে। ঠিক তখনই ভেসে এলো এক পুরুষ কণ্ঠস্বর,
“চাচি আম্মা, আমার চা টা দিন।”
শব্দটা কানে যেতেই তড়াক করে চোখ মেলে তাকালো আহিয়া। মুহূর্তেই বুকের ভেতর কেমন যেন ধাক্কা লাগলো।
ওই স্বরটা, ওটা তো আদনান ভাইয়ের! চোখ পিটপিট করে একবার ডানদিকে তাকালো। হ্যাঁ, সত্যিই তো আদনান সোফার টেবিলে ল্যাপটপ খুলে মন দিয়ে কিছু দেখছে। কপালে ভাঁজ, চোখে ভীষণ মনোযোগ। আহিয়ার চোখে ভর করে এলো অবাক প্রশ্ন,
“আদনান ভাই তো এ সময় বাসায় থাকেন না।হাসপাতালের ডিউটি থাকে সবসময়। তাহলে আজ গেলেন না কেনো?”
এই ভেবে ধড়ফড় করে উঠে বসল সে। ঠিক তখনই হালিমা বেগম এক কাপ চা এনে আদনানের হাতে দিলেন। তার চোখ গিয়েই পড়লো এখনো ঘুমে কুঁকড়ে থাকা আহিয়ার দিকে। কপাল কুঁচকে বলে উঠলেন,
“কখন থেকে ডাকছি তোকে, এখন আবার এখানে এসে ঘুমাচ্ছিস?”
আহিয়া হকচকিয়ে উত্তর দিলো,
“ডাকছো কেন?”
হালিমা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
“ডাকছো কেন মানে? মার্কেট যাবো বলেছি কাল রাতে। সব ভুলে গেছিস নাকি?”
“উমম…”
আহিয়ার গলা যেনো আধো ঘুমে ভারী।
“কি উমম! যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। এইভাবে আর কতক্ষণ ঘুমাবি?”
আহিয়া অনিচ্ছা নিয়ে মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। এদিকে আদনান চায়ের কাপ নামিয়ে চোখ তুলে একবার তাকালো তার দিকে। ঘুম মাখা মুখ, এলোমেলো চুল, শ্যামবর্ণ গালে ঘুমের ছাঁপ কেমন এক অদ্ভুত মাধকতা ছড়িয়ে ছিল আহিয়ার চেহারায়। চোখ দুটো যেনো আধো আলোতে মায়ার আবরণে ঢাকা।
আদনান কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো। অতঃপর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে গেলো। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সে আবার ল্যাপটপে চোখ নামিয়ে নিলো, যেনো কিছু হয়নি। ঠিক তখনই পাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর,
“ভাইয়া, তুমি হাসছো কেনো?”
চমকে পেছনে তাকালো আদনান। আদিবা তার রঙ পেন্সিল হাতে বসে আছে, আর বড় বড় চোখ মেলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করছে। আদনান এক মুহূর্ত থমকে গেলো। ঠোঁটের কোণে জমে থাকা হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে মুখটা শক্ত হয়ে গেল। গম্ভীর স্বরে বললো,
“কোথায় হাসলাম আমি?”
“আমি স্পষ্ট দেখেছি, তুমি হাসছিলে।”
আদনান মৃদু ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“আচ্ছা? হতে পারে।”
তার কণ্ঠে এমন এক দ্ব্যর্থবোধকতা ছিল, যেনো সে সত্যিটা এড়াতে চাইছে। কিন্তু আদিবা তো আর কিছু বুঝলো না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর আবার নিজের রঙ পেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতে বসে গেলো। আদনান ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। একটা দীর্ঘ, ভারী নিঃশ্বাস। যেনো নিজের ভেতরের কোনো অচেনা অনুভূতি চেপে রাখতে চাইছে।
ড্রইংরুমের সেই নীরবতার মাঝে এসে বসলেন আসফাক মীর আর আফরোজা শেখ। আফরোজা শেখ নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন, হাতে থাকা কিছু কাগজপত্রে চোখ বুলাতে লাগলেন। ভ্রুতে হালকা কুঁচকানো ভাজ, যেন প্রতিটি অক্ষর মনোযগ দিয়ে দেখছেন। এমন সময় পরিচারিকা রিতু এসে ট্রেতে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে গেলো। আফরোজা শেখ কাপ তুলে ধীরে চুমুক দিতে দিতে একবার চোখ তুলে তাকালেন আদনানের দিকে।
আদনান তখনো ল্যাপটপে পুরো মনোযোগ দিয়ে টাইপ করছে। তার চোখে-মুখে ক্লান্তি নেই, বরং গাম্ভীর্যের আস্তাবর ছাঁয়া। আফরোজা শেখ এবার ধীরে আসফাক মীরের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন,
“তোমার আদরের ভাতিজা কই? কাল রাতে যে বের হলো, তারপর থেকে আর বাসায় ফেরার নামগন্ধ নেই। নেশা করে কোথায় বুঁদ হয়ে আছে খোঁজ নিয়েছো?”
তার কণ্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট। চোখের কোণে জমে ওঠা ক্লান্তি যেন আহাদের নাম উচ্চারণের সাথেই তা দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। আসফাক মীর চুপচাপ বসে ছিলেন এতক্ষণ। এবার কফি-কালারের পাঞ্জাবির হাতা ঠিক করে এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে নিলেন। ঠোঁটের কোণে অল্প এক হাসি খেলে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন,
“শাহীনের বাসায় আছে। শাহীন নিজেই রাতে ফোন করে জানিয়েছে।”
আফরোজা শেখ ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। চোখেমুখে বিরক্তির রেখা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে বোঝা যাচ্ছিল, আহাদের এই বেপরোয়া আচরণে তিনি ক্লান্ত। তবুও যেন অসহায়ের মত চুপ করে গেলেন। এই ছেলেকে তারা কোনো নিয়মে, কোনো বাঁধনে আটকে রাখতে পারলো না। সেটা যেন প্রতিদিন আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছে। তিনি একটা দীর্ঘ, ভারী নিঃশ্বাস নিয়ে আবার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। ঠিক তখনই ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন হালিমা বেগম। তার হাতে শাড়ির আঁচল, বারবার টেনে গুছাতে গুছাতে ডেকে উঠলেন,
“আহি! তাড়াতাড়ি আয়, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
উপরের দিক থেকে ভেসে এলো আহিয়ার কণ্ঠ,
“আর দুই মিনিট…”
আফরোজা শেখ এবার ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
“কোথাও যাচ্ছো নাকি, হালিমা?”
হালিমা বেগম নিচু গলায় ভদ্র ভঙ্গিতে বললেন,
“জ্বি আপা, একটু মার্কেট যাবো। আদিবার জন্মদিনের টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা করা লাগবে।”
আফরোজা শেখ কিছুক্ষণ থেমে থেকে চুপচাপ মাথা নাড়লেন।
“আচ্ছা, ঠিক আছে। যাও।”
এমন সময় ধাপধাপ শব্দ করে নিচে নামলো আহিয়া।
চোখেমুখে হালকা সাজ, সাদা-কালো কম্বিনেশন জামা, কিন্তু মুখের ভেতরে আবারও সেই চিরচেনা দ্বিধা। সিঁড়ির ধাপে ধাপে নামার শব্দ যত জোরালো হচ্ছিল, আদনানের দিকে হঠাৎ চোখ যেতেই তার পদক্ষেপ থেমে এলো। মুহূর্তেই তার পায়ের শব্দ ম্লান হয়ে গেল। সে যেন নিশব্দ পায়ে, খুব সতর্কভাবে এসে দাঁড়ালো হালিমা বেগমের পাশে।
“চলো, চাচি আম্মা… আমি রেডি।”
হালিমা ব্যস্ত হয়ে নিজের ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বললেন,
“চল। আদনান, এসো।”
কথাটা শোনামাত্র আদনান ল্যাপটপ ধীরে নামিয়ে আঙুলের হালকা টোকায় সেটা বন্ধ করলো। এরপর ফোনটা পকেটে তুলে নিয়ে আদনান উঠে দাঁড়িয়ে আহিয়ার দিকে একবার তাকালো। সেই দৃষ্টি আহিয়ার বুকের ভেতর যেন ধক করে উঠলো। তার মুখ হালকা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তাড়াহুড়ো করে হালিমা বেগমের কানে কানে বললো,
“চাচি আম্মা, আদনান ভাইও যাবে?”
“হ্যাঁ, এই জন্যই তো আজ ছুটি নিয়েছে।”
আহিয়ার চোখ বিস্ফারিত। ঠোঁট কেঁপে উঠলো,
“কিহহ…! আমি যাবো না তাহলে।”
হালিমা কিছু বলার আগেই হঠাৎ আদনানের কণ্ঠ ভেসে এলো পেছন থেকে। গভীর, ভারী, অথচ শান্ত স্বর,
“আমি গেলে তোর কোনো সমস্যা?”
কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আবার বললো,
“সমস্যা থাকলে বল।”
আহিয়া তড়িঘড়ি মাথা নেড়ে দিলো, গলা কাঁপতে কাঁপতে বললো,
“না না… কী সমস্যা থাকবে?”
আদনানের চোখে যেন এক অদ্ভুত দীপ্তি খেলে গেলো।
মৃদু ভঙ্গিতে হেসে উঠলো,
“তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? চল।”
আহিয়ার ঠোঁটের কোণে জোর করা হাসি ফুটে উঠলো, খুবই কৃত্রিম,
“হ্যাঁহহহ…”
হালিমা বেগম এবার পেছনের ঘরে তাকিয়ে ডাক দিলেন,
“আদিবা! আয়।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই আদিবা দৌড়ে বেরিয়ে এলো, চোখেমুখে উচ্ছ্বাস ভরা। সবাই একসাথে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। বাহিরের আলো-হাওয়ায় দরজা খুলতেই এক ঝাপটা হাওয়া ভেসে এলো। চারজন একসাথে বাইরে পা রাখলো কেউ হাসি মুখে, কেউ গভীর গম্ভীর ভঙ্গিতে, আর কেউ বুকের ভেতর লুকানো অজানা অস্বস্তি নিয়ে।
রিদিতা হাতে রিমোট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ড্রয়িংরুমে। কখন থেকে নিজের পছন্দের গান খুঁজে যাচ্ছে, একের পর এক। কিন্তু মনমতো মিলাতে পারছে না। বারবার গানের প্রথম লাইন শোনে ভ্রু কুঁচকে আবার বদলে ফেলে। ঈশানী অনেকক্ষণ ধরে ওকে লক্ষ্য করছিল। শেষে ধৈর্য হারিয়ে তেঁতে উঠে বলল,
“সমস্যা কি তোর? দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া রিমোট নিয়ে কতক্ষণ ধরে টিপাটিপি করতেছিস?”
রিদি মুখ বাঁকিয়ে চ সূচক শব্দ করে বলে,
“আরে দাঁড়াও না। একটা গান খুঁজতেছি।”
ঈশানীর বিরক্তি এবার চরমে উঠে গেলো।
“তোরে আমি কাজ দিছি, রিদি! টেবিল আর সোফাগুলো একটু মুছতে বলছি, গান খুঁজতে না।”
রিদি হেসে একটু গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে,
“মুছবো তো বলছি। একটা গান চালায়া নেই। গানের তালে তালে মুছে দিবো।”
“তোর গান খুঁজতে খুঁজতে দিন পার হয়ে যাবে।”
বলেই সে বিরক্ত হয়ে পাশের রুমে চলে গেল। রিদি আর কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত একটা গান চালিয়ে দিয়ে কাজ শুরু করলো। তবে তার কাজের মাঝে হঠাৎ মাহি এসে লাফঝাঁপ শুরু করে দিলো পাশে। রিদি এক হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে বললো,
“সর সামনে থেকে। কাজ করতে দে।”
কিছুক্ষণ শান্ত থাকে মাহি, কিন্তু একটু পর আবারও এসে হাজির। গানের তালে তালে লাফায়। রিদি এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলে উঠলো,
“সুমইন্নার বাচ্চা! সামনে থেকে সর বলছি।”
মাহি এবার এক হাত কোমড়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা ভঙ্গিতে আরেক হাত নেড়ে বলে,
“তুই সর, এটা আমার বাপের বাড়ি। আমি যা খুশি তাই করবো।”
রিদি চোখ বড় বড় করে বলে,
“এহহহ..! বাপের ফুটাইতে আসছে।”
মাহি গলা ফাটিয়ে বলে,
“বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিবো।”
রিদি বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো। কণ্ঠে রাগ ঝরে পড়লো, দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“আহহ..! সাহস কত বড় ! এতটুকু বান্দরের বাচ্চা আমারে বের করবে! থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো তোর।”
“কিহহ! আমাকে থাপ্পড় দিবা? আজকে পাপা আসুক।”
“তোর বাপ আসলে কি হবে? তোর বাপেরে ভয় পাই আমি? যা এখান থেকে।”
মাহি টলমল চোখ নিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে কাঁদোকাঁদো ভঙ্গিতে দৌড়ে চলে গেলো সেখান থেকো। আর এটা দেখে রিদি আনন্দিত হলো। ঠিক তখনই একটা গান বেজে উঠলো,
“তোকে দেখে মনে মনে বাজলো যে গিটার
প্রেমের জালে ফেসে গেলো মনটা যে আমার
আয় তুই আমার হবি আয় আয় আয় আয়
দেবো তোকে দেবো ষোলো আনা,
করিস না বাহানা, তু মেরি গালি আ যা না।”
গান শুরুর সাথে সাথেই রিদি যেন অন্যরকম টালমাটাল হয়ে গেলো। হাত ছুঁড়ে দিয়ে, পা মেলিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করলো। তার ভেতরের চাপা অস্থিরতাগুলো যেন গানের তালে তালে বের হয়ে আসছে। ঈশানী পাশের রুম থেকে শব্দ শুনে বেরিয়ে এলো। দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নিজের আধ পাগল বোনের দিকে। রিদির চোখে-মুখে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস, আবার কিছুটা পাগলামির ছাঁপ। যখনই রিদি দুলতে দুলতে ঘুরলো, ঈশানীকে দেখে হকচকিয়ে থেমে গেলো। বুকে হাত দিয়ে বলল,
“আহহ..! ভয় পাইছি না..!”
ঈশানী এটা দেখে হেসে মাথা নেড়ে বললো,
“তুই তো গিরগিটির চেয়েও কম না রিদি! কাল তো সারাদিন গাল ফুলায়া বসে ছিলি। তাইলে আজকে এমন বান্দরের মত লাফাইতেছিস কেনো? ঘটনা কি?”
রিদি যেনো ধরা পরতে পরতে বেঁচে গেলো,
“ঘটনা কিছু না।”
এই বলে রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করে দিয়ে নিঃশব্দে নিজের রুমে চলে গেলো। ধপাস করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করতেই হঠাৎ রাতের দৃশ্যগুলো ভেসে উঠলো। আহাদের নেশালো কন্ঠ, তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, উল্টোপাল্টা কথা, সব শেষে হঠাৎ হাত ধরা। রিদির বুকের ভেতর কেমন জানি কাঁপন শুরু হয়ে গেলো।
ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠলো, শ্বাস দ্রুত হয়ে গেলো। নিজের অবস্থা বুঝতে পেরে একটা হাসি দিয়ে দ্রুত বালিশে মুখ গুঁজে দিলো সে। যেন নিজের কাছ থেকেই নিজেকে লুকাতে চাইছে। কিন্তু তবুও যেনো হৃদয়ের ভেতরটা ধরা দিয়ে ফেলেছে আহাদের জন্য।
সূর্যের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। রোদের তেজ জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকতেই কপালে এসে পড়ছে। সেই আলোয় আহাদের গভীর ঘুম ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এলো। এক সময় তার হাত-পা নড়ে উঠলো, আড়মোড়া ভাঙলো শরীরটা। কিন্তু চোখ খুলতে গেলেই বুঝলো, মাথার ভেতর যেন প্রচণ্ড ব্যাথা, শরীরটা ভারী হয়ে আছে।
অবশেষে ধীরে ধীরে চোখ মেলল আহাদ। তীব্র আলোয় চোখে খোঁচা লাগলো, আবার কুঁচকে বন্ধ করল। কিছুক্ষণ পরে হাই তুলে আবার চোখ খুললো। সামনে দেয়ালের ঘড়িতে দৃষ্টি পড়তেই ধড়ফড় করে উঠে বসল, দুপুর দুইটা পেরিয়ে গেছে! সে চমকে উঠলো। রাজনীতির মাঠে যেখানে প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে সে প্রায় আধা দিন পার করে দিয়েছে কেবল ঘুমিয়েই। মনে এক ধাক্কায় আতঙ্ক জাগলো,
“এভাবে চললে তো রাজনীতি গোল্লায় যাবে!”
আহাদ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। শরীর টান টান করে প্রসারিত করলো, মাথাটা চেপে ধরলো হাত দিয়ে। টেবিলে রাখা কালো জ্যাকেট, ফোন আর মানিব্যাগ হাতে তুলে নিলো। দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই পা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। গত রাতের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কাল রাতে সে একটু বেশিই মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এতটা ড্রিংক করা উচিত হয়নি। কিন্তু সে কি করবে নিজের প্রেয়সীকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে যে অপরাধ বোধ কাজ করতেছিলো। মনে হয়েছে সে রিদির সাথে একটু বেশি রুঢ় হয়ে গেছে। তাইতো নিজের যন্ত্রণা কমাতে এমন কান্ড করেছে। তবে এখন এসব পাগলামো করলে চলবে না। সামনে নির্বাচন নিজেকে সংযত রাখতে হবে। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। চারপাশে শত্রুদের আনাগোনা, যখন তখন রিদির সাথে দেখা করা যাবে না।তা না হলে তারা রিদিকেও আক্রমন করতে পারে তার দূর্বলতা ভেবে। নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত দূরুত্ব বজায় রাখতে তার প্রেয়সীর থেকে।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো আহাদ। ফোন বের করে রিদির সেদিনের ভিডিওটা দেখতে লাগলো। যেখানে রিদি খাচ্ছিলো ছোট বাচ্চাদের মত, ফুলে থাকা গালদুটো যেন মুখভর্তি অভিমান বহন করছে। ভিডিওর ভেতরকার দৃশ্য দেখে তার ঠোঁটে অজান্তেই এক চিলতে হাসি খেলে গেলো।
আঙুল দিয়ে আলতো করে স্ক্রিন স্পর্শ করে বললো,
“স্টুপিড!”
ভিডিও বন্ধ করে ফোনটা পকেটে রেখে দরজা খুলে বাইরে বের হলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই শাহীন তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলো।
“ভাই, আপনি উঠছেন?”
আহাদ চোখ কুঁচকে কটমট করে তাকালো।
“না, এখনো শুয়া আছি। রাবিশ!”
“সরি ভাই।”
আহাদ সোজা হাঁটতে থাকলো। দরজার কাছে পৌঁছে যাবার আগে শাহীন আবার ডাক দিলো,
“ভাই, নাস্তা করবেন না?”
আহাদ ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
“না শাহীন। তুই তো জানিস, আমি ফ্রেশ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুতেই স্বস্তি পাই না। খাওয়া-দাওয়া পরে হবে।”
শাহীন আর কিছু বললো না। আহাদের অভ্যাস, রুটিন, সবই তার জানা। ঠিক তখনই রান্নাঘরের দিক থেকে ভেসে এলো শাহীনের মা মমতাজ বেগমের ডাক,
“বাবা, চলে যাইতেছো?”
আহাদের পা থেমে গেলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো তার দিকে। মাথা নিচু করে বললো,
“জ্বি খালাম্মা, যাওয়া জরুরি।”
আহাদের কণ্ঠে শ্রদ্ধার সুর সবসময়ই থাকে মমতাজ বেগমের জন্য। আর মমতাজ বেগমও আহাদকে আপন সন্তানের মত ভালোবাসেন। আজ সকালেই যখন শুনলেন আহাদ এখানে আছে, তখন থেকেই রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। নিজ হাতে তার জন্য রান্না করেছেন, আহাদের পছন্দের খাবার। ভালোবাসায় ভরা চোখে তাকিয়ে বললেন,
“খাবারটা খাইয়া যাও বাবা। তোমার পছন্দের গরুর মাংস ভুনা করছি, পরোটা বানাইছি।”
আহাদ একবার টেবিলের দিকে তাকালো। নানান পদে সাজানো, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ভালোবাসার ছোঁয়া। কিছুটা দোটানায় পড়লো সে। শাহীন এগিয়ে এসে আস্তে বললো,
“মা, ভাইয়ের তো এখন সময় নাই, ভাই...”
শাহীনের কথা সম্পুর্ন হবার আগেই আহাদ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“ঠিক আছে খালাম্মা। আপনি যখন এত কষ্ট করেছেন, খেয়েই যাই। আমারও তো খুদা-টুদা লাগে নাকি?”
পেটে হাত বুলিয়ে একটু ভঙ্গি করে বলল কথাটা। এক হালকা হাসি ছুঁড়ে মুখ ধোয়ার জন্য বেসিনের দিকে এগিয়ে গেলো। ঠাণ্ডা পানি মুখে ছিটিয়ে আবার ফিরে এসে টেবিলে বসল। মমতাজ বেগম খুশি হয়ে তার সামনে একে একে খাবার সাজিয়ে দিলেন। আহাদ খেতে খেতে খুশি হয়ে প্রতিটি আইটেম চেখে দেখলো। প্রতিটি গ্রাসে যেন মায়ের স্নেহের স্বাদ মিশে আছে। তার মুখে পরিতৃপ্তির ছাঁপ ফুটে উঠলো। শাহীন চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। ভাইকে এত খুশি মনে খেতে খুব কমই দেখেছে। অবাক হয়ে মুখে হালকা হাসি ফুটলো।
অবশেষে নাস্তা শেষ করে আহাদ বাইরে বেড়িয়ে এলো। চুলে হাত বুলিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বসতেই শাহীন এগিয়ে এলো। একটু দোনমনো করে বলল,
“থ্যাংক ইউ ভাই!”
আহাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“ফর হোয়াট?”
“এই যে আমার মাকে এতটা গুরুত্ব দিলেন, প্রায়োরিটি দিলেন। মা সত্যিই অনেক খুশি হইছে আপনাকে পেয়ে।”
আহাদ ক্ষীণ হেসে মাথা নাড়লো।
“শাহীন, তোর মা আমার কাছে খালার মতো। আমার কোনো খালা নাই, আমি উনিকে সেই নজরে দেখি। এটা নতুন কিছু না, তুই জানিস। তাহলে এসব উদ্ভট শব্দ আসছে কোথা থেকে?”
তারপর গলা শক্ত করে যোগ করলো,
“আবার এমন কথা বললে থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো। চল এখন।”
শাহীন তড়িঘড়ি মাথা নুইয়ে বললো,
“সরি ভাই।”
বলে দ্রুত নিজের গাড়িতে গিয়ে বসল। কয়েক মুহূর্ত পরে আহাদের গাড়ি, পেছনে শাহীনের গাড়ি দুটি গাড়ি একসাথে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো।
মাগরিবের নামাজ সেরে সবে মাত্র সোফায় এসে বসেছে রিদিতা। হালকা প্রশান্তি জমেছে তার চোখেমুখে। টেবিল ভরা মাহির খাতা-পত্র, রংপেন্সিল সব ছড়ানো। ঈশানী বসে মনোযোগ দিয়ে মাহিকে পড়াচ্ছে। ঘরের ভেতর শান্ত পরিবেশ, শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ ভেসে আসছে। রিদি ফোনটা হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে স্ক্রল করছে, এমন সময় হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। সে একটু ভ্রু কুঁচকে উঠে গেলো। দরজা খোলামাত্র চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেলো, সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট নাদিম। গম্ভীর চেহারা, হাতে একটা বক্স। রিদির দুই ভ্রুর মাঝখানে গভীর ভাজ পড়লো।
“আপনি… এখানে?”
নাদিম মাথা নুইয়ে একটা বক্স এগিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“এটা ভাই পাঠিয়েছে। আপনার জন্য।”
রিদির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো।
“আমার জন্য?”
“জ্বি।”
রিদি একবার পেছনে ঘুরে তাকালো। ঈশানী খানিকটা কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে। সেও কিছু না বলে কেবল দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। রিদি হাত বাড়িয়ে নিলো বক্সটা। নাদিম শুধু মাথা নেড়ে একপাশ ঘুরে চলে গেলো। দরজা বন্ধ করে বক্সটা নিজের রুমে নিয়ে চলে এলো রিদি। বিছানায় বসে বক্সটা উল্টেপাল্টে দেখছে। মন কেমন করছে অদ্ভুতভাবে,
“আহাদ হঠাৎ কি পাঠাতে পারে?!”
কৌতূহল আর অস্থিরতা চেপে রাখতে না পেরে সে বক্সটা খুললো। ভেতরে ছোট্ট একটা চিরকুট। সে কাগজটা তুলে পড়তেই চোখ কুঁচকে গেলো।
“আপনার বাচ্চাটাকে সামলে রাখবেন মিস জানু!”
রিদির মাথায় যেন বজ্রপাত হলো।
“বাচ্চা!? কিসের বাচ্চা?!
ধড়ফড় করে আবার বক্সটা ঘুরালো। ভেতরে হাত দিতেই
হঠাৎই একটা ব্যাঙের বাচ্চা লাফিয়ে উঠে তার গায়ে পড়লো।
“আআআহহহহহহ…!!!”
একটা আতঙ্কিত চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলো রিদি। বুক ধড়ফড় করতে লাগলো প্রচণ্ড ভয়ে। সে এক লাফে ওয়ারড্রবের ওপর উঠে বসে পড়লো। মুখ ফ্যাকাশে, বুক উঠানামা করছে দ্রুত তালে। চিৎকার শুনে দৌড়ে এলো ঈশানী। চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে বললো,
“কি হইছে? চিৎকার করলি কেন? আর এভাবে উপরে উঠে বসে আছিস কেন?”
রিদির গলা শুকিয়ে গেছে, তবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“ব.. ব.. ব্যাঙ!”
ঈশানী কপাল কুঁচকে চারদিকে তাকালো।
“ব্যাঙ? কই ব্যাঙ?”
রিদি কাঁপা হাতে আঙুল তুলে ইশারা করলো। ঈশানীর পায়ের কাছে সত্যিই একটা ছোট্ট সবুজ ব্যাঙ লাফাচ্ছে।
ঈশানীও এবার চিৎকার করে উঠলো।
“আআআহহ!!”
এক লাফে সে বিছানার ওপর উঠে দাঁড়ালো। হাঁপাতে হাঁপাতে মুখ বিকৃত করে বললো,
“ব্যাঙ আসছে কোথা থেকে?!”
দুই বোনই ভয়ে জমে রইলো, কেউ নামলো না নিচে। রিদি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে, মুখে কোনো কথা নেই।
ঠিক তখনই রিদির ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে স্পষ্ট আহাদের নাম্বার। রাগে দাঁত কটমট করে রিসিভ করলো রিদি। ওপাশ থেকে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠ,
“বাচ্চা পছন্দ হয়েছে, মিস জানু?”
কণ্ঠের ভঙ্গিতে যেন মুচকি হাসি লুকানো। রিদির বুকের ভেতর রাগে আগুন জ্বলে উঠলো। সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“এটা কেনো করলেন আপনি?”
“কি করলাম?”
“ব্যাঙ পাঠালেন কেনো?!”
আহাদ নির্লিপ্ত সুরে বললো,
“যাক বাবা, ব্যাঙের বাচ্চাটা তার মায়ের কাছে যেতে কান্নাকাটি করছিলো। তাই তো সাহায্য করলাম, মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। অন্যায় করে ফেল্লাম নাকি?”
রিদি ক্ষোভে ফুঁসলো, “হ্যাঁ, অন্যায় করেছেন!”
আহাদ গলা নামিয়ে নরম কিন্তু কটাক্ষ মেশানো ভঙ্গিতে বললো,
“অন্যায় তো আপনিও করেছেন।”
“আমি কি করেছি?”
“দু’বার কল দিয়েছি, রিসিভ করেন নাই।”
রিদি গর্জে উঠলো,
“তাই বলে আপনি ব্যাঙের বাচ্চা পাঠিয়ে দিবেন?”
“এখন তো শুধু বাচ্চা পাঠিয়েছি। এরপর যদি আবার এমন করেন, তখন কিন্তু পুরা বংশধর পাঠিয়ে দিবো, জা নু।”
ওপাশের কণ্ঠে যেন মজা, খুনসুটি, আবার হুমকির ছোঁয়াও। রিদি আর কথা খুঁজে পেলো না। রাগে শরীর কাঁপতে লাগলো। গলা আটকে এলো। অবশেষে প্রচণ্ড ক্ষোভে ফোন কেটে ছুড়ে মারলো বিছানার ওপর। বুক ভরে উঠলো আক্ষেপে। নিজের উপর নিজেরই ক্ষোভ হলো। ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড় করে বললো,
“আরে বজ্জাত বেটা… সত্যি সত্যি তোর কপালে আধ পাগল বউ জুটবে দেখিস!”
সে ধপ করে বিছানায় নেমে বালিশে মুখ গুঁজে দিলো। চোখে পানি চলে এলো রাগ আর দুঃখে। বুকের ভেতর ভরা অভিমান তাকে দমিয়ে আনলো না বরং সে মনে মনে আহাদকে অজস্র অদ্ভুত বদদোয়া দিতে শুরু করলো।

No comments:

720

Powered by Blogger.