#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী
পরের দিনটা ছিলো মীর হাউজের জন্য একটু ভিন্ন। সকাল থেকেই বাসার পরিবেশে একটা কেমন ব্যস্ততার আমেজ। কারন আজ তাদের ছোট মেয়ে আদিবার জন্মদিন। যদিও অনেক বড় আকারে উদযাপন করা হয়নি, তবুও ছোট্ট একটা আয়োজনের রেশ যেন বাড়িটাকে অন্যরকম করে তুলেছে। বাসার ভেতরে যেন এক অদৃশ্য আনন্দ ছড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা নামতেই আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করলো।
যেহেতু আদিবা আর আহিয়ার সব বন্ধুদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। তাই একে একে আনিকা, নীলা, তামিম, সাব্বির সবাই চলে এলো। তবে এখনো রিদিতা এসে পৌঁছায়নি। তামিম এসেই প্রথমে চারপাশে চোখ বুলালো। স্পষ্ট বোঝা যায় সে রিদিকে খুঁজছে। কিন্তু কোথায়ও চোখে পড়লো না। মনের ভেতর হালকা অস্থিরতা তৈরি হলো তার। সে আনিকার পাশে গিয়ে ধীরে জিজ্ঞেস করল,
“আনিকা, রিদিতা আসবে না?”
আনিকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো,
“জানিনা। বলছিলো আসতে ইচ্ছা করছে না। তবে আহিয়াকে নাকি বলেছে আসবে। দেখি, শেষ পর্যন্ত আসে কিনা।”
এই কথাতেই তামিমের ভেতরে এক অদৃশ্য শূন্যতা নেমে এলো। সে তো শুধু রিদির সাথে দেখা হবে ভেবেই এসেছে, তা না হলে আসতই না। এমন সময় সাব্বির পাশ থেকে ঠাট্টার সুরে বলে উঠলো,
“দোস্ত, দেখ… তোর অস্থিরতার কারন আসছে!”
তামিম চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো। সত্যিই মূল দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে রিদি। রিদির পরে আছে গাঢ় আকাশি নীল রঙের একটা গাউন। সাজগোজ নেই তেমন, শুধু ঠোঁটে হালকা লিপ গ্লস। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে চুল ভালো করে ঢেকে দিয়েছে। হাতে ছোট্ট একটা গিফটবক্স। সবার ভিড়ের মাঝেও তাকে যেন একেবারেই আলাদা দেখাচ্ছিলো। তামিম নিজের আবেগ চাপতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“হাই রিদিতা।”
“হাই।”
“এতো দেরি করলে? আমি তো ভাবছিলাম আসবেই না।”
রিদি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“আসতে তো চাইনি, কিন্তু আহিয়ার জোরাজুরিতে আসতে হলো।”
“ভালোই হয়েছে এসেছো। দেখা হয়ে গেলো।”
পাশ থেকে আনিকা খোঁচা দিয়ে বলে উঠলো,
“দেখা তো প্রতিদিনই হয় ভার্সিটিতে।”
তামিম কেমন যেনো গড়বড় খেয়ে হেসে ফেলল,
“আররে, আমি সে কথা বলিনি। আমি তো শুধু...”
ঠিক তখনই আহিয়া দৌড়ে এসে রিদিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি ভীষণ খুশি হয়েছি তুই আসছিস।”
আনিকা মুখে দুষ্টু হাসি টেনে কটাক্ষ করে বলল,
“এতই যখন দরদ, তখন ভাইয়ের বউ করে এ বাড়িতে রেখে দিলে তো পারিস।”
এই কথায় রিদির বুক ধপাস করে উঠলো। মুহূর্তেই সে আনিকার হাত শক্ত করে চেপে ধরে। চোখ কটমট করে ইশারা করলো,
"চুপ!"
আহিয়া একটু ভেবে নিয়ে সত্যি সত্যিই বলে ফেলল,
“আরে! এটা তো আমি ভেবেই দেখিনি। আদনান ভাইয়ের জন্য তো মেয়ে খুঁজতেছে, অথচ মেয়ে তো আমাদের সামনেই আছে। আম্মুকে বলতে হবে এই ব্যাপারে।”
তামিম, আনিকা আর রিদি, একসাথে তিনজন চিৎকার করে উঠলো,
“কিহহহহ!! মাথা খারাপ!”
আহিয়া অবাক হয়ে তাকালো সবার দিকে। ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেনো? খারাপ কী বললাম?”
রিদিতা কেমন যেনো ঘাবড়ে গেলো। অস্বস্তি হচ্ছিল তার, শব্দ খুঁজে পেলো না। শেষে শুধু বলল,
“আমার ঘটকালি করার দরকার নেই তোর।”
“কেনো?”
“কারণ ওর ক্রাশ আছে।”
আনিকার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো কথাটা, বলেই সে সাথে সাথেই নিজের জিহ্বা কামড়ে ফেলল। রিদি কটমট করে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। আহিয়া চমকে গিয়ে বলল,
“ওহ! তাই তো, আমি ভুলেই গেছিলাম। তোর ক্রাশ কে সেটা তো বললি না সেদিন।”
তামিমের চোখ এক ঝলক রিদির দিকে গেলো। রিদিও আড়চোখে তাকালো একবার। তামিমের ঠোঁটে হালকা এক মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে সে ভেবে নিলো, হয়তো রিদির ক্রাশ সে নিজেই। তাই কিছু না বলে শুধু মুখ টিপে হাসল। আহিয়া এবার রিদিকে হালকা ঝাঁকিয়ে বলল,
“কি রে, বল না!”
সবাই তখনো রিদির দিকে তাকিয়ে আছে। সেই মুহূর্তেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা গেলো আহাদ রাজাকে। ঘরের পরিবেশ এক নিমেষে থমকে গেলো। সবার দৃষ্টি গিয়ে আটকে গেলো তার ওপর। রিদির বুকটা কেমন অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠলো। শুভ্র রঙের প্যান্ট-শার্টে সজ্জিত আহাদ, প্রতিটা ধাপে পা রাখতেই চুলগুলো হালকা দুলে উঠছে। তার চলার ভঙ্গিতে এমন এক আত্মবিশ্বাস, যেন চারপাশের সব আলো কেবল তার জন্যই। শেষ ধাপে নেমে এসে সে চুলে হাত বুলালো, আর তখনই তার চোখ আটকে গেলো রিদির চোখে। রিদির ধারালো দৃষ্টি সোজা গিয়ে বিঁধলো আহাদের বুকে। বুকের ভেতর চাপা একটা ব্যথা, সাথে অদ্ভুত এক টান অনুভব করল। মনে হলো ফুসফুস বেড়িয়ে আসবে। সে অবচেতনভাবে বুকটা চেপে ধরলো। হঠাৎই একটা তৃষ্ণার্ত ভারী ঢোক গিললো। তার গলার কন্ঠ মনির নড়াচড়া স্পষ্ট দেখা গেলো। রিদির দিকে তাকিয়ে সে বুঝলো, সে কোনো এক অচেনা আবেশে বন্দী হয়ে গেছে।
আনিকা হঠাৎ খেয়াল করলো রিদির দিকে। সবার সাথে দাঁড়িয়ে থাকলেও রিদি যেন পুরোপুরি অন্য জগতে হারিয়ে গেছে। তার দৃষ্টি অবিচল হয়ে আটকে আছে আহাদ রাজার দিকে। চোখের ভেতর কেমন যেনো অদ্ভুত ঝিলিক, ঠোঁট সামান্য ফাঁকা। মনে হচ্ছে দুনিয়ার সবকিছু মিলিয়ে গেছে, শুধু আহাদই আছে তার সামনে। আনিকা অবাক হয়ে মুহূর্তখানিক তাকিয়ে থাকলো রিদির মুখের দিকে। অতঃপর হালকা দুষ্টুমি ভরা ভঙ্গিতে কনুই দিয়ে রিদির বাহুতে ধাক্কা দিলো।
“মুখটা বন্ধ কর। কি দেখছিস এভাবে?”
অচেতন ঘোর ভেঙে রিদি হকচকিয়ে উঠলো। চোখের পলক ফেলতে ফেলতে দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। তার কোমল গাল বেয়ে হালকা লালচে আভা নেমে এলো। আর সেই দৃশ্যটা কিন্তু এড়িয়ে গেলো না আহাদের চোখ। তার ঠোঁটের কোণায় এক চাপা হাসি খেলে গেলো। দাঁত দিয়ে হালকা ঠোঁট কামড়ে হাসিটা আরও চেপে রাখলো। ধীরে ধীরে সিঁড়ি থেকে নেমে এসে সোফায় গিয়ে বসল আহাদ। এক পা অন্য পায়ের উপর তুলে হেলান দিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিলো। আড়চোখে প্রতি মুহূর্তেই নজর রাখছে তার প্রেয়সীর দিকে।
এমন সময় বাইরে থেকে গটগট করে ভিতরে ঢুকলো আদনান। আহিয়া হঠাৎ রিদির হাত ধরে জোর করে ঘুরিয়ে দিলো দরজার দিকে। উৎসাহীত হয়ে বলল,
“দেখ রিদি! আদনান ভাই আসছে..!”
মুখোমুখি হলো আদনান আর রিদিতা। মুহূর্তেই বুকের ভেতর ধপাস করে উঠলো রিদির। সে একদম জমে গেলো আহিয়ার এমন কান্ডে। দৃষ্টি নামিয়ে রাখলো নিচের দিকে। তবে আহিয়া তাকাতেই দেখলো আদনানের চোখে যেনো শীতল অগ্নি। শক্ত চোয়াল, রাগে চেপে ধরা ঠোঁট। কটমট করে তার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে, যেনো চোখ দিয়েই গিলে খাবে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে, সে দ্রুত পাশ ফিরে আনিকার পিছু গিয়ে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়াল।
সামান্য পাশ ফিরে ঘাড় কাত করে তাকাতেই রিদির চোখ আটকে গেলো আহাদের দিকে। রিদির কেমন দম বন্ধ হয়ে এলো। যেনো নিঃশ্বাস আটকে গেছে। হাত কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কারন আহাদের চোখ আর আগের মতো কোমল ছিলো না। জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতো দৃষ্টি গেঁথে বসেছে তার চোখে। সেখানেই যেনো আগুনের লেলিহান শিখা, রাগ, ঈর্ষা, অধিকারবোধ সব একসাথে। আহাদের চোখে পড়লো রিদির ড্রেসের সাথে আদনানের শার্ট ম্যাচিং হয়ে গেছে। যদিও সেটা কাকতালীয়, তবুও তার ক্রোধে শরীর ফেটে যাচ্ছে। আর তা দেখে রিদি খুশখুশে কাঁশতে শুরু করলো। তামিম, যে নীরবভাবে সব দেখছিলো এতক্ষণ। সে দ্রুত এগিয়ে এসে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো রিদির দিকে,
“রিদিতা! এই নাও, পানি খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”
রিদি কোনো তোয়াক্কা না করেই এক নিঃশ্বাসে পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো। পানি শেষ করে ধীরে ধীরে চোখ খুলে আবার তাকাল আহাদের দিকে। গম্ভীর মুখ, ঝলসে যাওয়া চোখ, একরাশ ক্রোধ নিয়ে গটগট করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলো আহাদ। রিদির বুক থেকে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে হলো যেন বুকের ওপর থেকে বিশাল কোনো পাথর নেমে গেছে।
সে আবারও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে চারদিকে চোখ বুলালো। চোখ ঘুরে গিয়ে আবার থেমে গেলো যেখানে আহাদ ছিলো সেখানে। তার ভেতরে অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হলো। চোখে হালকা বিস্ময়, ঠোঁটে মৃদু কাঁপন। অচেতনেই মনে মনে সে বুঝলো আহাদের অনুপস্থিতি তাকে অস্থির করে তুলছে। সে এবার মুখ শক্ত করে তাকালো আহিয়ার দিকে, আহিয়া একটা কৃএিম হাসি দিয়ে বলে,
“সরি! আমি বুঝতে পারিনাই।”
“সরি মাই ফুট! তোকে তো আমি...”
রিদি দাঁত কিড়মিড় করে বলে কথাটা। এর মধ্যেই হালিমা বেগম সবাইকে ডেকে নেন কেক কাটার জন্য। আদিবা ও তার কয়েকজন বান্ধবি মিলে এসে সেখানে এসে হাজির হয়। আর তারপর শুরু হয় হট্টগোল।
★
আহাদ শরীরে ক্রোধের আগুন নিয়েই রুমে ঢুকলো। দরজায় এক ঝটকা লাথি মারতেই দরজাটা ঠাস করে দেয়ালে ধাক্কা খেলো। রুমে ঢুকেই হঠাৎ চমকে উঠলো, ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে নীলা। তার চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাঁপ। আহাদের দৃষ্টির সঙ্গে চোখ মেলাতে না পেরে নীলা একপা পিছু হটে গেলো। আহাদ গর্জে উঠলো,
“নীলা! আমার রুমে কি করছিস তুই?”
নীলা গলা শুকিয়ে ঢোক গিললো, কাঁপা গলায় বললো,
“আ… আহাদ ভাই…”
আহাদ দাঁতে দাঁত পিষে আরও ভয়ংকর গলায় বললো,
“আই আসকিং ইউ! কার পারমিশন নিয়ে আমার রুমে ঢুকেছিস? আমার রুমে কেন এসেছিস?”
নীলা কেঁপে উঠে তোতলাতে লাগলো,
“আস… আসলে আমি চা… চার্জার খুঁজছিলাম।”
আহাদের রক্ত যেনো আরও গরম হয়ে উঠলো। চোখ লালচে হয়ে উঠলো ক্রোধে,
“চার্জার খুঁজছিলি? তো আমার রুমে কেনো? আরো অনেকের রুমই তো আছে। আহির রুম আছে, আদির আছে, চাচি আম্মার রুম আছে। আমার রুমে আসার সাহস হলো কেমন করে তোর? আমার রুমে বাহিরের কারো আসা আমি পছন্দ করি না। সেটা কি তুই নতুন জানিস?”
নীলার মুখ শুকিয়ে গেলো। গলায় কাঁপুনি নিয়ে বললো,
“স… সরি…”
“বেরিয়ে যা! রাইট নাও। কুইক!”
আহাদ এক ধমক দিয়ে গর্জে উঠলো, আহাদের চোখের জ্বলন্ত আগুনে নীলা আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়ালো না। হুড়মুড় করে এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তার নিঃশ্বাস হাঁপাচ্ছে, বুক কাঁপছে। সে ভাবেনি আহাদ এত দ্রুত উপরে এসে পড়বে। রুমে একা দাঁড়িয়ে আহাদ যেনো আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তার ভেতরের আগুন যেনো কোনভাবেই শান্ত হতে চাইলো না। বরং রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হঠাৎ পায়ের জোরে চেয়ারে লাথি মারলো। চেয়ারটা উল্টে গিয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো।
এদিকে নিচে আদিবার জন্মদিনের কেক কাটা শেষ হয়েছে। সবাই আনন্দ-ফুর্তিতে নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে। হাসি, আড্ডা আর কোলাহলে ভরে আছে ঘর। কিন্তু রিদি সোফার এক কোনে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। মনটা অকারণেই ভারী হয়ে উঠে। হঠাৎ মাথায় ঝলক দিয়ে উঠলো গত রাতের ঘটনাটা। আহাদের উদ্ভট আচরণ ঘুরপাক খেতে লাগলো মনে। রিদির বুকের ভেতর শক্ত হয়ে এলো, এটা নিয়ে আহাদকে সরাসরি প্রশ্ন করতে হবে। কারণ, আহাদকে সে পছন্দ করে। তার উল্টোপাল্টা রাগ-অভিমান, শাস্তি সব সে মেনে নিতে পারবে হয়তো। কিন্তু পরিবার? তারা তো কখনোই এসব মেনে নেবে না। তাই সাহস সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। পা টিপে টিপে আহাদের রুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। যদি আবার রেগে যায়? যদি চিৎকার করে? তাকে শাস্তি দেয়? এই ভেবে এক মুহূর্ত দ্বিধায় পড়লো। ঘুরে যেতে নিলেই, ভেতর থেকে আহাদের কর্কশ করাতের মত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“যেটা বলতে এসেছিস সেটা বলে যা, জানু।”
রিদি চমকে উঠলো। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেলো। তবুও ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখলো।আহাদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই শ্বাস আটকে এলো তার।আহাদ একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে, পা দুটো তুলে দিয়েছে টেবিলের উপর। এক হাতে ধরা জ্বলন্ত সি'গা'রে'ট। টেবিলের উপর খোলা অ্যা'ল'কো'হ'লে'র বোতল আর আধখাওয়া গ্লাস। তার গাঢ় বাদামি চোখ আগুনের শিখার মতো জ্বলছে। রিদি বিস্ময়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলো এক মূহুর্ত। এরপর মুখ থেকে ফিসফিস শব্দে বেরিয়ে এলো,
“আপনি… বাসায় বসেও নেশা করছেন?”
আহাদ হালকা হেসে, নিঃশ্বাসে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়লো,
“নেশায় নেশা কাটে। এক নেশা দূর করতে আরেক নেশার সাহায্য নিতে হয়।”
রিদি চোখ শক্ত করে বললো,
“নেশা করা হারাম। ইসলামে জায়েজ নেই। এতে পাপ হয়।”
আহাদ বিদ্রূপে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উঠলো। চেয়ার থেকে পা দুটো নামিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাতে গ্লাস তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো রিদির দিকে। চোখে ভয়ঙ্কর দৃষ্টি। রিদির সামনে এসে সামান্য ঝুঁকে নিচু গলায় বললো,
“ইবলিশ শয়তানকে পাপ-পুণ্যের পার্থক্য শেখাতে এসেছো?”
রিদির নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে এলো। তবুও সাহস করে বললো,
“নাহ! আমি… আমি গত রাতের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”
আহাদ ভ্রু কুঁচকে ঠান্ডা গলায় বললো,
“কি কথা?”
“আপনি কালকে এমনটা কেনো করলেন?”
আহাদ হঠাৎ জোরে হেসে উঠলো,
“আজকে এমনটা কেনো করলাম, সেটা জিজ্ঞেস করবে না জানু?”
রিদি ভ্রু কুঁচকালো, “কোনটা?”
“এটা..!”
এই বলে আহাদ হঠাৎ গ্লাসটায় এক চুমুক দেয়। এরপর কয়েকবার গ্লাসটা ঘুরিয়ে এক ঝটকায় ঢেলে দিলো রিদির মাথার উপর। অ্যা'ল'কোহ'লে'র গন্ধে চারদিক ভরে গেলো। রিদি আঁতকে উঠে নাক-মুখ শক্ত করে খিঁচে নিলো। তার জামা ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে পুরোপুরি। চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে কাঁপুনি নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“এমনটা কেনো করলেন আপনি? আমার জামা নষ্ট হয়ে গেছে!”
আহাদ ঠান্ডা, হিমশীতল গলায় বললো,
“সেটাই তো চেয়েছি আমি!”
রিদি ভ্রু কুঁচকে বললো,
“মানে?”
“মানে আজকের পর থেকে এই রঙ তোর জন্য নিষিদ্ধ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেনো এই রঙ গায়ে জড়াতে না দেখি।ড্রেস চেন্জ করো, কুইক।”
আহাদের চোখ জ্বলে ওঠে, কাঠ কাঠ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল কথাটা। রিদির বুক কেঁপে উঠলো। চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে অবিশ্বাস। রঙের সাথে তার রাগের সম্পর্ক কি? কিছুই বুঝতে পারলো না। তবুও সাহস করে রাগে গলা কাঁপিয়ে বললো,
“আমার যখন ইচ্ছা, যে রঙ ইচ্ছা আমি সেটাই পরবো। তাতে আপনার কি?”
আহাদ হঠাৎ ভয়ংকর দৃষ্টি মেলে গর্জে উঠলো,
“এমন ব্যবস্থা করব, সারা জীবন শুধু সাদা রঙ গায়ে জড়িয়ে শান্তিতে শুয়ে থাকতে পারবি। তখন শুয়ে শুয়ে চিন্তা করিস, আমার কি?”
রিদির চোখ টলমল করে উঠলো অভিমান আর আঘাতে। বুকটা হুহু করে উঠলো। সে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারলো না। চোখের অশ্রু চেপে ঘুরে দাঁড়ালো। কিন্তু বেরিয়ে যেতেই আহাদ আবার কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠলো,
“আহিয়ার রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ড্রেস চেন্জ করো। কুইক!”
রিদি একবারও ফিরে তাকালো না। তার চোখে ক্ষোভ, অভিমান আর অশ্রুর কুয়াশা। গটগট করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। রুমের ভেতরে শুধু রইলো ধোঁয়া, অ্যা'ল'কো'হ'লে'র তীব্র গন্ধ আর আহাদের দমফাটা ক্রোধ।
আহিয়ার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আহিয়ার দেওয়া সাদা-কালো কম্বিনেশনের কুর্তি-পায়জামা পরে নেয় রিদি। আয়নার সামনে একবার নিজেকে দেখে সে মাথা ঝেঁকিয়ে নেয় কাজল ছাড়া ফ্রেশ মুখ, ভেজানো কণ্ঠ এখন খানিকটা ভয়াবহ স্মৃতি দমন করছে। এভাবে তো আর এতো মানুষের মধ্যে যাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে পোষাক বদলাতে হলো। আহিয়া অদ্ভুত চোখে রেদিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী করে এত ভিজে গেলি?”
রিদি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো। কোনো ব্যাখ্যা দিলো না, শুধু নির্লিপ্ত কণ্ঠটা বেধে উঠলো,
“বাদ দে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি এখনই বাসায় যাচ্ছি।”
আহিয়া উঠে এসে কাঁধে হালকা চেপে দিলো,
“আজ থেকে যা না! যাওয়া লাগবে না আজকে।”
রিদির ঠোঁটের কোণে কণ্ঠ খানিকটা তীক্ষ্ণ,
“মাথা খারাপ! অসম্ভব। সুমন ভাই রাগ করবে, তাছাড়া আব্বু জানতে পেলে ক্যাচাল হবে।”
আহিয়া একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নেয়, তারপর কণ্ঠে কেমন আবেগ মিশে বলে,
“কি আর করার। ঠিক আছে, সাবধানে যাস”
“আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।”
একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেই বিদায় নিলো রিদিতা। মূল দরজা পেরিয়ে গেটের দিকে আসতেই, অপ্রত্যাশিতভাবে সামনে পড়ে আমজাদ মীর। আমজাদ মীরের দিকে তাকিয়ে রিদির হঠাৎ সেদিনের ঘটনা মনে পড়তেই লজ্জার এক রৌদ্রহীন আভা, শরীরটা ঢেকে দিল তার। মুহূর্তের মধ্যে মাথা নুইয়ে সে সালাম দিল,
“আসসালামু আলাইকুম।”
আমজাদ মীর প্রথমে একটু বিব্রত হলেন, তবুও বিদ্রুপ-গলার মধ্যে দিয়ে জবাব দিলেন,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
তিনি পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু রাতের এই নীরবতায়, রিদিকে একা দেখে চিন্তিত হতে বাধ্য হলেন। রিদি তো তাঁর নিজের মেয়ের মতো, বাবার স্নেহ-গহ্বর মতো কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন,
“তুমি একা যাবে?”
রিদি অনড়, কণ্ঠে কোনো ভঙ্গিমা নেই। শুন্যতার মতো পরিষ্কার সিদ্ধান্ত, “জি আংকেল।”
আমজাদ মীর একবার কপাল কুঁচকে বললেন,
“এত রাতে একা যাবে? চলো, আমি ড্রাইভারকে বলি, ও তোমাকে নিয়ে যাবে।”
রিদি অচঞ্চল কণ্ঠে প্রত্যাখ্যান করল,
“না, না আংকেল, আমি যেতে পারবো। ওতো রাত্রো ও হয়নি।”
কিন্তু তার কণ্ঠে যতটুকু ভর ছিল, ততটুকুই ভঙ্গুর। এই ভঙ্গুরতার পেছনেই ঘাসফোঁটা লজ্জা লুকিয়ে ছিল। তখনই পেছন থেকে বড়ো পা নিয়েই এগিয়ে আসে আহাদ। তার আগমনে রিদির কপালে তীব্র রাগের রেখা ফুটে উঠল। তার গা হঠাৎ কাঁপল, মুখটা শক্ত হয়ে গেলো, চোখ ক্ষণিকের জন্য এক অদৃশ্য ভয়ের ঢেউ বেয়ে উঠল। রিদি আমজাদ মীরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি আসছি।”
এই বলে রিদি বড় বড় পা ফেলে গেটের দিকে এগিয়ে গেলো। আহাদ হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে নিজের বাবাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করল। এতে আমজাদ মীর একটু বিব্রত হলেন, এক ধাপ পেছন সরে গেলেন। তার কণ্ঠে খাঁ খাঁ শব্দে বের হল,
“এভাবে শকুনের মত দেখছো কেনো আমাকে?”
তার মুখে অস্বস্তির রেখা। আহাদ ঠোঁটটা হালকা টানল, মৃদু তির্যক হাসি। পিতা-পুত্রের মধ্যকার যে তিক্ততায় আজ নতুন মাত্রা ঢুকেছে তা উভয়েই বোঝে। আহাদ সরাসরি কটাক্ষ করে বলে উঠলো,
“নিজের বয়সটা মাথায় রেখো, তাছাড়া ঘরে বউ-বাচ্চা আছে, সেটা ভুলে যেও না।”
“মুখে লাগাম টানো বেয়াদব ছেলে।”
আহাদ প্রবল কণ্ঠে ধিক্কার দিলো, “তোমারই তো ছেলে!”
“সেটাই তো সবচেয়ে বড় আফসোস, যে তোমার মতো ঠোঁট কাটা বেয়াদব ছেলে আমি জন্ম দিয়েছি।”
আহাদের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ, চোখে কোনো অনুশোচনা নেই। কণ্ঠে বিদ্রূপ মিশিয়ে বলল,
“জন্ম দিয়েছ কেন? আমি বলেছি আমি এই পৃথিবীতে আসতে চাই! প্লিজ আমাকে আনো। জন্ম যখন দিয়েছো, এখন ভুক্তভোগী হও। আর হ্যাঁ, মিশা সওদাগরের মত, একদম আমার প্রেমে বাগড়া দিবা না। তাহলে দুই মিনিটও লাগবে তোমার ডিভোর্স করাতে?”
“নিজের বাবাকে ধমক দিচ্ছো?”
“হ্যাঁ।”
আমজাদ মীরের কণ্ঠ কেটে আসে, চোখে লজ্জা আর হতাশার মিশ্র অনুরাগ।
“বেয়াদব ছেলে।”
“না। তোমার ছেলে।”
আহাদ এবার আর এক ধাপ এগিয়ে এসে বাবর কানের কাছে নিচু গলায় বলল,
“আরেকটা কথা, এই আহাদ রাজা থাকতে, তার রিদি রানি একা যাবে কেনো? এটা তো বোঝা উচিৎ ছিলো! ম ন্ত্রী
ম শা ই।”
তার কণ্ঠে এক ধরনের অধঃপতন আর দাবি,
“যাই নিজের প্রেয়সীকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে আসি, বাই।”
বলেই চোখ টিপে দিয়ে বাতাসের মত পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে গেলো। বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো গেটের দিকে। চলতে থাকা আহাদের পিছনে তাকিয়ে আমজাদ মীর কয়েকবার শ্বাস নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন,
“আল্লাহ, কোন পাপের ফল এটা আমার! আমার নিজের ছেলে আমার সংসার ভাঙ্গা নিয়ে হুমকি দেয়।”
আমজাদ মীর খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশায় মাথা নেড়ে ভিতরের দিকে পা বাড়ালেন। অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতি সহ সব কিছুই বহমান রাত্রির মাঝে মিলিয়ে গেল।
No comments: