জুস খেয়ে আমি কিছুক্ষণ রেস্ট নিতেই আমার প্রছন্ড পেট ব্যথা শুরু হয়।
মনে হচ্ছে পেটের সবকিছু ফেটে বেরিয়ে আসছে।
প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। এমন কেনো হলো হঠাৎ করে?
আমি কয়েকবার নিধিকে ডাকলাম কিন্তু নাহ কোনো সারা শব্দ নেই নিধির।আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে।কি হলো আমার?
জুসের মধ্যে কি তবে কিছু ছিল?কথাটা মাথায় আসতেই আমি চমকে উঠলাম।
তখনই মাহিন ছুটে এলো।
আমার মাথাটা নিজের কোলের উপর নিয়ে বলল,,
"কি হয়েছে মেহের?"
আমি ব্যথায় কথা বলতে পারছিনা।মাহিন আমার অবস্থা দেখে কিছু একটা আশংকা করলো।দ্রুত আমাকে কোলে তুলে বের হলো রুম থেকে।
নিধি ব্রেডে জেলি লাগাচ্ছিলো।মাহিনকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,,
"তুমি এখন বাসায় কি করছো মাহিন? আর ওর কি হয়েছে?"
মাহিন পারেনা চোখ দিয়ে নিধিকে জ্বালিয়ে দেয়।
আমাকে নিয়ে বের হয়ে যেতে যেতে মাহিন বলল,,
"কাজটা ঠিক করোনি নিধি।এর পরিনাম ভালো হবেনা।"
নিধি শুকনো ঢক গিলল। ছুটে রুমে গিয়ে দেখলো কোনো ব্লাড আছে কি না! নাহ বিছানার চাদরে কোনো ব্লাড নেই!
সন্ধ্যা ছয়টা বাজে।চারদিকে মাগরিবের আজান হচ্ছে।
মাহিন কর্ম জীবনে যোগ দেওয়ার পর কোনোদিন নামাজ পড়েনি অথচ আজ মাহিন নামাজে দাড়িয়েছে।
সময়ের সাথে নিজের পাপের পাল্লা ভারী করেছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পায়নি।আজ নিজ সন্তানের সুরক্ষা কামনায় মাহিন রবের কাছে দুহাত তুলে প্রার্থনা করছে।
সময় আর পরিস্থিতি হয়তো আসলেই মানুষের মাঝে একটু হলেও পরিবর্তন আনে।
নামাজ শেষে মাহিন ছুটলে হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
হসপিটালে পৌঁছেই ডক্টর নীলার মুখোমুখি হয় মাহিন।আইসিইউর সামনে ড.নীলা দাড়িয়ে ছিলো।মাহিন এক পলক আইসিইউতে নজর বুলিয়ে ড.নীলাকে জিজ্ঞেস করলো,,
"ডক্টর বেবি?"
ড.নীলা মাহিনের অস্থিরতা দেখে বললেন,,
"এ যাত্রায় বেবি বেচে গেছে।কিন্তু বেবির হয়তো জন্মের পর কোনো সমস্যা হতে পারে।সিওর নই আমি তবে আশংকা আছে।"
মাহিন ডক্টরের শেষ কথাগুলো ঠিকভাবে শুনলো না।বেবি ঠিক আছে শুনেই মাহিনের মাঝে খুশির ঝলক দেখা গেলো।ড.নীলা আরও বলল,,
"আজকের দিনটা মেহেরকে অবজারভেশনে রাখবো।"
"ঠিক আছে ডক্টর।"
মাহিন আইসিইউর ভেতরে এসে কিছুক্ষণ বসে রইলো।এরপর একটা ফোন আসায় বের হয়ে গেলো হসপিটাল থেকে।
আমার জ্ঞান ফেরে রাত আটটায়।ডক্টর নীলা আমাকে সবটা বলে।তিনি আমাকে এও বলে যে,,
"মাহিনের চোখে আজ প্রথম আমি তোমার জন্য ব্যাকুলতা দেখেছি মেহের। তুমি যখন কষ্ট পাচ্ছিলে মাহিন তা অনুভব করছিলো।আর তাই সে নামাজে দাড়িয়ে পড়ে।"
আমি হাসলাম ডক্টরের কথা শুনে।বললাম,,
"আমার জন্য না নিজের সন্তানের জন্য ছিলো এগুলো।
আমি তো শুধু একটা মাধ্যম এখানে।আমার উপর মাহিনের কোনো অনুভূতি নেই ডক্টর।"
"উহু,হয়তো বেবির জন্যই মাহিন অস্থির হয়েছিলো কিন্তু তার ৫০% তোমার জন্যও ছিলো।আমার চোখ ভুল করবেনা মেহের।"
কথাটা বলেই ড.নীলা চলে গেলেন।আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। পদে পদে এতো বিপদ আর সহ্য হয়না আমার।কবে যে একটু শান্তি পাবো।
____________________________________
সময় গড়ালো।দীর্ঘ রাত শেষে নতুন ভোরের সূর্য উঠলো।সূর্যের আলো চোখে পড়তেই আমার ঘুম ভাঙলো।তাকিয়ে দেখি মাহিন আমার হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।
আমার নড়াচড়াতে মাহিনের ঘুম ভেঙে যেতেই ও জিজ্ঞেস করলো,,
"ঠিক আছো এখন? কোনো কষ্ট হচ্ছে কি?"
"না,ঠিক আছি।"
মাহিন সস্তির শ্বাস ছাড়লো। এরপর উঠে গেলো।
কিছুক্ষণ এর মাঝেই নার্স এলো আমাকে নিতে।
একঘন্টার মধ্যে সমস্ত ফর্মালিটি শেষ করে বাসায় ফিরলাম।রুমে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতেই নিধির চিৎকার শুনতে পেলাম।মাহিনের সাথে আবারো ঝগড়া করছে।এরা এতো ঝগড়া কেনো করে? কি সমস্যা এদের?
হাহ!আমার আর ভালো লাগছেনা। অনেকক্ষণ চিল্লাচিল্লির পর নিধি আমার কাছে এলো।
আমাকে বলল,,
"তুমি চলে যাও।আমাদের তোমাকে দরকার নেই।
তোমার জন্য শুধু শুধু আমার সংসারে ঝামেলা হচ্ছে। চলে যাও মেহের।"
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।কোথায় যাবো আমি?মার চিকিৎসা কে করবে? আর এই বেবি, ওর কি হবে?
আমাকে ভাবতে দেখে নিধি আমার হাত ধরলো।আমাকে সোজা রুম থেকে টেন বের করে আনলো।এরপর দরজা খুলে দিয়ে বলল,,
"চলে যাও মেহের।"
এবার রুম থেকে মাহিন ছুটে এলো।নিধিকে বলল,,
"ওর সাথে এমন করছো কেনো?"
নিধি উত্তর করলো না।ও আমাকে বের করে দেওয়ার জন্য আমাকে ধাক্কা দিলো।আমি কোনোরকম দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিলাম।মাহিন ছুটে এসে আমার পাশে দাড়ালো।নিধির গালে চর বসিয়ে দিয়ে বলল,,
"আজ তুমি সব লিমিট ক্রস করে ফেলেছো নিধি।তোমার জন্য আজ আমার বাচ্চার লাইফ রিস্ক হয়েছে।তবুও আমি তোমাকে কিছু বলিনি।এখন আবারো তুমি মেহেরকে ধাক্কা দিলে! তোমার কি লজ্জা নেই?"
নিধি গালে হাত দিয়ে আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,,
"ওর জন্য তুমি আমাকে এতো কথা শোনাচ্ছো।ও একটা বাহিরের মেয়ে মাহিন।আমি মা হতে পারি ওকে আমাদের মাঝে দরকার নেই।আর না ওর বাচ্চার দরকার।তাই ওকে আজ আমি আমাদের জীবন থেকে বের করে দিচ্ছি।"
আমি অবাক হলাম নিধির এই পরিবর্তন দেখে। প্রথম যেদিন আমার সাথে নিধি দেখা হয় হসপিটালে ও বলেছিলো ও কখনো মা হতে চায়না কেননা এতে করে ওর বডির ফিটনেস নষ্ট হবে আর মুখের উজ্জ্বলতাও হারিয়ে যাবে।সামান্য একটা বাচ্চার জন্য ও এতো কিছু হারাতে পারবেনা।
সেই নিধি আজ বলছে ও মা হতে চায়।ওরা আমাকে কি পুতুল ভেবেছে? যখন যা ইচ্ছে হবে তাই করাবে।আমি পারছিনা আর এসব নিতে। মাহিন আমাকে দুহাতে ধরে রেখেছে বলেই দারিয়ে থাকতে পারছি নাহলে আমার ক্ষমতা নেই দাড়িয়ে থাকার।
নিধি এবার আরও কিছু বাজে কথা বলল যা বলার মতো না।আমার সাথে আমার মাকে তুলে কিছু বলতে গেলে মাহিন বাধা দেয়।এতে করে মাহিনের সাথে ভয়াবহ ঝগড়া হয় নিধির।এক পর্যায়ে নিধি বাসা ছেড়ে চলে যায়।
অন্য সময় হলে মাহিন হয়তো নিধির পিছনে যেত তবে আজ যায়নি।মাহিনের প্রচন্ড রাগ উঠেছে বোঝাই যাচ্ছে।
মাহিন আমাকে রুমে দিয়ে চলে গেলো নিজ রুমে।
আমার এখন নিজেকে সব থেকে নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে। আমার জন্য একটা সংসারে ঝামেলা হচ্ছে। মা যদি জানতে পারে তাহলে তো এমনিতেই মরে যাবে।
নাহ আমাকে শক্ত থাকতে হবে।নিজের জন্য না হোক বাচ্চাটার জন্য ঠিক থাকতে হবে।কথাগুলো ভেবে এক দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লাম।
_______________________________________
দুইমাস পর,,
এই দুই মাসে নিধির কোনো খবর আমি পাইনি।হয়তো মাহিন ঠিকই জানে নিধির কথা তবে আমাকে বলেনি।আর আমারো সাহস হয়নি জিজ্ঞেস করার।তবে এই দুইমাসে মাহিন কাজ নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে।
আমার যায়গা এখন মাহিনের বেড রুমেই হয়েছে।মাহিন তেমন রাগ করেনা আমার উপর।আমি যতটুকু মাহিনকে বুঝেছি ও এমনিতে ভালো তবে ওর কথা না শুনলে ওর রাগ উঠে যায়।
আর সেই সময় মাহিন হিংস্র হয়ে পড়ে।
আজ আবারো চেকআপ করাতে এসেছি।
আলহামদুলিল্লাহ আজ আমার বাচ্চার হার্ট বিট পাওয়া গিয়েছে।
আমার থেকে বেশি খুশি আজ মাহিন হয়েছে।ও এই প্রথম খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
সেই মুহুর্তে আমি থমকে গেছি।মাহিনের মুখে এই কয়েকমাসে আমি হাসি দেখিনি অথচ আজ ও হাসছে।
মাহিন পুরো হসপিটালের সবাইকে মিষ্টি মুখ করায়।উপস্থিত সকলে অবাক চোখে আজ মাহিনের খুশি দেখছে।
আজ আল্ট্রাতে বাবুকেও দেখা গিয়েছে।মাহিনের খুশি যেন ধরে না।সাড়ে পাঁচমাস চলছে আমার।পেট অনেকটাই বোঝা যায়।এখন মায়ের সাথে দেখা করা সম্ভব না।
তবুও দূর থেকে একবার মাকে দেখতে চাই আমি।মাহিনের মুড ও ভালো আছে।তাই আমি মাহিনকে গিয়ে বলি,,
" শুনন?"
"বলো।"
"আমি আজকে একটু হার্ট ফাউন্ডেশনে যেতে চাই।"
মাহিন কথাটা শুনে চুপ করে রইলো। আমি আবারো বললাম,,
"আমি দূর থেকে দেখে চলে আসবো মাহিন,প্লিজ।"
"আচ্ছা চলো।"
মাহিন আমাকে নিয়ে গেলো হার্ট ফাউন্ডেশনে।
আমি মায়ের কেবিনের সামনে দাড়িয়ে মাহিনকে জিজ্ঞেস করলাম,,
"কেমন আছে মা এখন?"
"ভালো আছে।এই কয়েক মাস অবজারভেশনে থেকে উনি এখন প্রস্তুত অপারেশনটার জন্য।সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী পরশুদিন উনার অপারেশন করবো।"
আমি চমকালাম কথাটা শুনে।মাহিন তো বলেছিলো বেবি হওয়ার পর ও অপারেশন করবে।তাহলে এখন মত পাল্টালো কেনো?
কথাটা মাহিনকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি।মাহিন আমাকে কিছু বলতে উদ্যত হতেই পুলিশ অফিসার এবং নাইমকে দেখা যায় রিসেপশনে।
মাহিন আমাকে ধাক্কা দিয়ে মায়ের কেবিনে ঢুকিয়ে দরজা বাহির দিয়ে লক করে পর্দা টেনে দেয়।
মা ঘুমাচ্ছিলো আমার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকায়।
চলবে?
রিচেক করা হয়নি। ভুল ক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন more...
No comments: