অধ্যায় – ১ : শহরের রাত
ঢাকা শহর যেন কখনো ঘুমোয় না। কিন্তু রাত সাড়ে দশটার পর কমলাপুর স্টেশন একটু একটু করে নির্জন হতে থাকে।
আয়ন দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। পরনে সাদা শার্ট, যা সারাদিনে ধুলায়-ঘামে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হাতে ছোট্ট ব্যাগ—ভেতরে শুধু কিছু কাগজপত্র আর একটা পুরনো স্মার্টফোন।
আজকের দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হতে পারত। দেশের শীর্ষ একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে ইন্টারভিউ ছিল। সকালে যখন বাসা থেকে বের হয়েছিল, বুক ভরা আশা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ইন্টারভিউ শেষ হতেই মনে হলো সবকিছু কতটা অনিশ্চিত।
“আমি কি আদৌ পারব?”—প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
তখনই পিছন থেকে মেয়েটির কণ্ঠ ভেসে এল।
অধ্যায় – ২ : অচেনা মুখ
“ভাইয়া, এটা কি চট্টগ্রামগামী ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম?”
আয়ন ঘুরে তাকাল। মেয়ে আধুনিক পোশাক পরা, চুলগুলো একটু এলোমেলো, যেন দৌড়ে এসে পৌঁছেছে। হাতে ল্যাপটপ ব্যাগ। চোখে ক্লান্তি, তবু একটা আত্মবিশ্বাসী ঝলক।
“হ্যাঁ,” আয়ন উত্তর দিল, “ট্রেন ছাড়বে আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে।”
মেয়েটি হালকা হেসে বলল,
“উফ! বাঁচা গেল। অফিস থেকে সরাসরি ছুটে এলাম। মনে হচ্ছিল আর পারব না।”
আয়ন চুপচাপ তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর সে বলল,
“আপনি কি ঢাকায় থাকেন না?”
“না, চট্টগ্রামে। একটা প্রেজেন্টেশনের জন্য আসতে হয়েছিল। আপনি?”
“আমি ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম। হয়তো চাকরি হলে ঢাকায় থেকে যেতে হবে।”
ট্রেনের সিটি বেজে উঠল। মেয়েটি তাড়াহুড়া করে এগিয়ে গেল। উঠার আগে হঠাৎ থেমে আয়নের দিকে তাকাল।
“চাকরিটা আপনার হয়ে যাক। আপনার চোখে আশা আছে—এমন চোখে ব্যর্থতা মানায় না।”
তারপর ট্রেনটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
অধ্যায় – ৩ : নতুন সাহস
মেয়েটির কথা অচেনা হলেও, অদ্ভুতভাবে বুকের ভেতর সাহস জাগাল আয়নের।
সে যেন বুঝল, পৃথিবীতে এখনো কেউ আছে, যে তাকে বিশ্বাস করতে পারে—even যদি সে অচেনা হয়।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠল আয়ন। শহরের আলো ঝলমলে রাত হঠাৎ করে তাকে আর ততটা ভারী লাগল না।
অধ্যায় – ৪ : আবার দেখা
কয়েক সপ্তাহ পর, এক সকালে আয়ন ইমেইল পেল—
“Congratulations! You are selected.”
সে চাকরি পেয়ে গেছে। আনন্দে চোখ ভিজে উঠল।
প্রথম দিন অফিসে যোগ দিয়ে কনফারেন্স রুমে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেল আয়ন।
সামনের টেবিলে বসে আছে সেই মেয়ে।
হালকা হেসে সে বলল—
“ওহ! আপনি? ট্রেনের স্টেশনের সেই রাতটা মনে আছে?”
আয়ন অবাক হয়ে বলল,
“আপনি… এখানে কাজ করেন?”
মেয়েটি মাথা নেড়ে উত্তর দিল,
“হ্যাঁ, আমি কর্পোরেট ট্রেইনার হিসেবে এসেছি। আপনার নতুন জার্নির সঙ্গী আমিই।”
অধ্যায় – ৭ : নতুন সঙ্গী
অফিসের বাইরে প্রথমবার একসাথে আড্ডা দিতে বের হলো আয়ন আর অনন্যা।
একটা ছোট্ট কফিশপে বসে অনন্যা বলল—
“ঢাকা শহরটা আমার ভালো লাগে, কিন্তু কখনো আপন মনে ঘোরার সুযোগ পাই না। সবসময় দৌড়ঝাঁপ, কাজ আর ডেডলাইন।”
আয়ন হাসল, “আমার তো উল্টো। ঢাকার ভিড়, কোলাহল—সবই এখনো অচেনা। মাঝে মাঝে মনে হয় হারিয়ে যাচ্ছি।”
অনন্যা তাকাল তার দিকে, “তাহলে একটা কাজ করা যাক। তুমি আমাকে নতুনভাবে ঢাকা চিনতে সাহায্য করবে, আর আমি তোমাকে শহরের ভিড়ে হারিয়ে যেতে দেব না।”
ওই মুহূর্তে দুজনের মধ্যে একটা নীরব অঙ্গীকার তৈরি হলো।
অধ্যায় – ৮ : সময়ের সাথে সাথে
দিনগুলো দ্রুত বদলাতে লাগল।
অফিসের পর মাঝে মাঝে একসাথে বসে চা খাওয়া, ছুটির দিনে বইমেলায় যাওয়া, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো স্মৃতি শেয়ার করা—সব মিলিয়ে তাদের বন্ধুত্ব গভীর হয়ে উঠল।
একদিন সন্ধ্যায়, তারা বসেছিল হাতিরঝিলে।
আয়ন হঠাৎ বলল—
“তুমি জানো, আমি আগে খুব একা ছিলাম। চাকরির জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের ভেতরের স্বপ্নগুলোও হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি আর একা নই।”
অনন্যা চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল—
“আমিও তাই মনে করি। জীবনে যত অর্জন করেছি, তবুও একসময় একা লাগত। এখন আর লাগে না।”
দুজনের চোখে সেই মুহূর্তে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল।
অধ্যায় – ৯ : সম্পর্কের রঙ
কয়েক মাসের ভেতরেই অফিসে সবাই লক্ষ্য করল—আয়ন আর অনন্যা একসাথে থাকলে পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে যায়।
আয়ন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে, আর অনন্যা অনেকটা শান্ত, হাসিখুশি।
কেউ কেউ মজা করে বলত—
“শেষ ট্রেন থেকে শুরু, তাই না?”
অনন্যা হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে জানত, সেই “শেষ ট্রেনের রাতটাই” তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
No comments: