নীল_হৃদয়ের_শীতলতা
আরাবিহা_মেহেনাজ
নীল শীতল নিবাস বেশ স্তব্ধতা। সূর্যের কিরণে চারপাশটা বেশ ঝলমলে। অপরিজিতা ফুলের সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে কিরণের কারণে। নীল রংয়ের কিরণ বেশ ফুটে উঠেছে। গুমোট পরিবেশ কারো মুখে কোন রা শব্দ নেই। সবাই যেন নির্বিকার। নীরবতা ভাঙলো জুহায়ের বাচ্চা টা কে কোলে তুলে নিয়ে নিয়ে বলল
"ফ্লাইপাখি তোমার পাপা ডাক দাও"
বাচ্চা টি কৌতুহলী হয়ে বলল
"পাপা?"
"হুম"
এবার বাচ্চা টি সামনের ব্যাক্তির কে দেখলো ।এই চেহারা সে বহু বার তার জু-পা এর ফোনে দেখেছে এবং তাকে জু-পা শিখিয়েছে এটা তার পাপা । আ্যশভিন নিওরের দিক তাকিয়ে বলে উঠলো
"পাপা "
নিওরের কাছে মনে হল সে পৃথিবীর সবচাইতে শ্রুতি মধুর শব্দ শুনছে। এর চাইতে মধুর শব্দ পৃথিবীতে এখনো সৃষ্টি হয়নি তার শরীরের নিউরনগুলো জানান দিচ্ছে সে আনন্দিত সুখী একজন মানুষ এই মুহূর্তে। ঠিক বিশ সেকেন্ড পর জ্ঞান হারালো। লুটিয়ে পরল মাটিতে । হয়তো অতি সুখে। এমন কঠোর মানুষের এত নরম রূপে সবাই হতবাক। সবচাইতে হতভাগ হয়েছে লিয়ান । সে তার স্যারকে সবসময় সবার সাথে রাগি কণ্ঠস্বর কথা বলতে শুনেছে ।সেই স্যারের কি অবস্থা নিজ চোখে দেখলেও বিশ্বাস করা যায় না ! সবার বুঝতে পুরো এক মিনিট লাগলো ঘটনা কি হয়েছে। তারা বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না আ্যশভিন নিওর মত মানুষ "পাপা " ডাক শুনে জ্ঞান হারিয়েছে। এটা কি তারা হাস্যকর বিষয়ের মাঝে ফেলবে নাকি দুঃখের! সবার চেহারায় এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা গেল । তবে সবার মাঝে ফিহা দাঁত গুলো বের করে হেসে দিলো। সবাই তার দিকে তাকাতেই সে ন্যানো সেকেন্ডে দাঁতের কপাটিকে বন্ধ করল। তার সিরিয়ার সময় হাসি পায় এটা তার গুরু বলা যায় ।সে কি করবে এমনটা সে কি ইচ্ছা করে নাকি । সবার এভাবে তাকানোর কি আছে ভেবে পাইনা ফিহা। তিভিহা শুরুতে চলে গেছে। কই এত বছর পর স্বামী এসেছে চোখ জুড়িয়ে দেখবে, চোখে চোখে কথা বলবে তা না এ লৌহমানবী উপস্থিতি নেই এখানে।
আ্যশভিন নিওরের পাঁচ মিনিট পর জ্ঞান ফিরে আসলো। সে দেখল তার অবস্থান ড্রয়িং রুমে। তার পাশেই সেই ছোট্ট পুতুলটি বসে রয়েছে। ফিহা বলে উঠলো
" আমাদের ফ্লাইপাখি" ভাইয়া। তোমার মেয়ে।
আ্যশভিন জুহায়ের দিক তাকালো। সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছেন আর ভয়ে ঢোক গিলছে।
আ্যশভিন ভরাট গম গমে স্বরে বলে উঠলো
"ফিহা ওকে নিয়ে উপরে যা।"
হাটু গেড়ে বাচ্চাটির সামনে বসলো । খুবই সতর্কতার সাথে হাত দিয়ে গাল ছুঁয়ে দিল। তুলোর মত নরম গাল । তার এরকম শক্ত হাতে তার পুতুল যদি ব্যাথা পায়। তাই তার এত শতো সতর্কতা। ফিহা ফ্লাই পাখিকে নিয়ে যেতেই আ্যশভিন জুহায়ের কে মা রতে শুরু করে । সবাই নিরব দর্শক সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হচ্ছে তারা কি প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝতেই পারছে না। কি করবে তাও বুঝতে পারছ না। তাদের মস্তিষ্ক কি তবে অচল হয়ে পড়েছে। মস্তিষ্কে একটা জিনিসই জানান দিচ্ছে তা হচ্ছে ভয়। আ্যশভিন নিওরের রাগ নীল শীতলের প্রতি কণা জানে। জড় বস্তুতে তার রাগ সম্পর্কে অবগত । জড় বস্তুর উপর ই তার রাগ মিটানো হয় । যখন দেখলো জুহায়ের নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। এবার আ্যশভিনের বাবা লাহ্দ ওয়ায়েজ গর্জে ওঠো বললেন
"কি হচ্ছে আ্যশভিন ?ওকে মারছো কেন ?ছাড়ো ওকে!"
আ্যশভিন তার থেকে দ্বিগুণ চিৎকার করে বলে উঠলো
"আপনি আমার বাবা? একটা ভুলের জন্য এত বড় শাস্তি?"
"সেটা তোমার প্রাপ্য।"
সাথে সাথে আ্যশভিন ভেইস ফেলে দিল শব্দ করে কাঁচের টুকরো গুলো ভেঙ্গে ফ্লোরে পরলো। রক্তচক্ষু নিয়ে জুহায়েরের দিক তাকালো। জুহায়ের আ্যশভিনের হাত টেনে বাইরে নিয়ে আসলো।
"আমার কথা একবার শুনো ।"
"ধোকা দিয়েছিস আমায় । "
"আমার কথা শুনবে তুমি ?"
"না "
"প্লিজ । কারণ টা তো শুনো। "
হাঁটতে হাঁটতে তাদের বাড়ির পাশের মাঠে এসেছে । বাড়ি থেকে মাঠ টার দূরত্ব পাঁচ মিনিটের। মাঠে এসে আ্যশভিন সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে পরলো জোহায়ের এসে বসল । তার নাক দিয়ে র ক্ত গড়িয়ে পড়ছে নাকে টিস্যু দিল যাতে রক্ত থেমে যায় । জুহায়ের বলতে শুরু করলো ,
"তুমি চলে যাওয়ার পর নীল শীতল একদম স্তব্ধ গিয়েছিল । সবাই মন মরা হয়ে থাকতো। অথচ নীল শীতলের প্রত্যেকটা মানুষ ছিল হাসিখুশি । আল্লাহ হয়তো সেই খুশি আমাদের " নিহতা ফ্লাইবা " এর মধ্যমে দিয়েছে । ভাবি কারো সাথে কথা বলতো না। ফিহা বেশ কষ্ট করে তার সাথে ভাব জমায়। তবুও সে কোনো কিছুতেই স্বাভাবিক হতো না । তার মুখে হাসি দেখা গেছে কিনা বলা মুশকিল । দেখতে দেখতে চার মাস কেটে যায় ।
__________
চার মাস আগে
মারিয়া বিন দরজায় নক করে। হাতে তার খাবারের ট্রে । রুমের ভেতর থেকে উত্তর আসে দরজা খোলা আছে। সে রুমে ঢুকে গিয়ে পাশে বসে তিভিহার । মেয়েটাকে এই বাড়ী আসার পর সে হাসতেই দেখেনি কত সুন্দর একটা মেয়ে চোখ দুটো অসম্ভব সুন্দর
চেহারায় মায়া মায়া ভাব যে কেউ দেখে মায়ায় পড়তে বাধ্য। অসম্ভব সুন্দর রমণী। এই রমণীকে ফেলে তার ছেলে কিভাবে চলে গেছে । এত পাষা ণ কেন তার আ্যশভিন। সে তো এত পাষা ণ নয় তার স্বামী সেই মানুষটাও তো পাষা ণ নয় তবে এই ছেলে এত পাষা ন হলো কিভাবে! ভাবনা থেকে বের আসে । তিভিহা বলে
"আন্টি রুমে আনার দরকার ছিল না আমি আসতাম নিচে।"
"তাই । কয়টা ? বারোটায়! "
"ওই আর কি! "
"আমার মেয়েকে আমি এত অনিয়ম করতে দিব না। "
মরিয়ম বিন আবার বলে ওঠে
"তুমি কি কোন ভাবে আমাকে আম্মু ডাকতে পারো না? যেভাবে ফিহা ডাকে!"
এতদিনে মেয়েটার মুখে একটা মুচকি হাসি দেখা গেল সাথে সাথে ডেকে উঠলো
"আম্মু "
মরিয়ম বিনের হাসি চওড়া হয় ।
"নাস্তা খাও"
"আপনি খেয়েছেন ?"
"না । আমি খেয়ে নিব । তুমি খাও "
মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন
"খেয়ে নিচে এসো মাথায় কত দিন ধরে চিরুনি দাও না। মাথায় তেল দিয়ে দিব নিচে আসে। "
তিভিহা হাসলো। চার মাস ধরে এই রূপই দেখে আসছে সে মানুষটা এত ভালো কেন? এতো ভালো হতে হবে কেন তাকে? প্রথম প্রথম সে ভাবতো এগুলো লোক দেখানো হয়তো দুইদিন আসল রূপ ফিরে আসবে। কিন্তু না তাকে ভুল প্রমাণিত করে এই রূপের কোন দ্বিতীয় রূপ মরিয়ম বিনের মাঝে দেখেনি । মানুষটা মায়ের মত তাকে আগলে রাখছে। সেই মানুষকে আম্মু ডাকতে কার্পণ্য করা মোটেই উচিত নয় । আরো একবার দরজায় নক হলো। তিভিহা জানে কে এসেছে।
ভরাট এক কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো,
"তুমি তোমার শাশুড়িকে আম্মু বলেছ?"
"জ্বী আঙ্কেল"
লাহ্দ ওয়ায়েজ মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল ।
"তুমি এত বড় বেইনশাফি করতে পারলে ?"
"কেন?"
"সে আম্মু আর আমি আঙ্কেল ! "
লাহ্দ ওয়ায়েজ এর কণ্ঠস্বর বেশ করুণ শোনালো।
তিভিহা মুখটা কাচুমাচু করে বলল
"মাই মিসটেক আব্বু ।"
এবার লাহ্দ ওয়ায়েজ মুখটা বেশ উৎফুল্ল দেখা গেল। বিশ্বকাপ জয় করার হাসি তার মুখে।
" আমি মিষ্টি খেয়ে আসি। তোমার শাশুড়ি আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে দুটো মিষ্টি খেয়েছে কারণ তুমি নাকি তাকে আম্মু ডেকেছো আর আমি যখন খেতে চাইলাম তখন বলল তুমি কেন খাবে? তোমাকে কি আব্বু ডেকেছে ?মানে এটা কোনো লজিক হলো ব্যাককল মহিলা একটা।
তিভিহা হাসলো বহুদিন পর সে মন খুলে হাসছে।
লাহ্দ ওয়ায়েজ এবার তিভিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
"এভাবে সবসময় হাসিখুশি থাকবে।"
_______________
পড়ন্ত বিকেলে ফিহা আর জুহায়ের রেডি হয়ে বসে আছে ড্রয়িং রুমে তাদের একমাত্র ভাবীর জন্য খুব কষ্টে তাকে রাজি করিয়েছে ঘুরতে যাওয়ার জন্য । প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর তিভিহার দেখা মিলল। সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে । মাঝে সিঁড়িতে এসেই হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ল ঠিক কয়েক সেকেন্ড পর জ্ঞান হারিয়ে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়লো। আকস্মিক ঘটনায় দুজনই অতি আশ্চর্য । যখন বুঝতে পারল কি হয়েছে তাড়াতাড়ি সবাইকে ডেকে উঠলো। এরপর তাদের বাড়ির ডক্টর আসলো। তিভিহা কে চেকআপ করে বলল
"নীল শীতল বাসীদের জন্য সুখবর । সি ইজ প্রেগন্যান্ট। "
এই ঘটনা সবাই কি বলবে কি প্রতিক্রিয়া করবে বুঝে উঠতে পারলো না। এত খুশির সংবাদেও কেউ যেন মন খুলে খুশি হতে পারছে না তাদের হাত-পা কাঁপছে কেন? কাঁপছে অতি খুশিতে নাকি দুঃখে ! তাদের অনুভূতি নিয়ে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বিত ! সবচাইতে আশ্চর্য মুখ দেখা গেল তিভিহার মাঝে। সবচাইতে অপ্রিয় সত্য শুনেছে সে। কি করবে সে এখন ? তার কি খুশি হওয়ার উচিত নয়? অবশ্যই উচিত তবে সে খুশি হতে পারছে না কেন। যার লোক তাকে ফেলে রেখে চলে গেছে তার সন্তানকে সে কি বলবে কি গল্প শোনাবে যে তার বাবা বিয়ের পরদিন তাকে রেখে চলে গেছে! তিভিহা বলে উঠলো
"আমি একটু একা থাকতে চাই "
রুম থেকে সবাই একা একা উঠে চলে যেতে লাগলো । তিভিহা নিজের চুল টেনে ধরল তার অসহ্য রকমের মাথা ব্যথা করছে। কি করবে সে? জীবন কেন তাকে এত কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে সবচাইতে সুন্দর অনুভূতি কে সে সুন্দর বলে মানতে পারছে না । অসুন্দর বলতে সাই দিচ্ছে মন , খুশি হতে পারছে না ওই জঘন্য লোকের জন্য। তিভিহার রুম থেকে মাঝ রাতে দেশ ভাঙচুরের শব্দ পাওয়া গেল । বিকট আওয়াজে পূরণের সকল কেঁপে কেঁপে উঠলো। তবে কেউ এগিয়ে আসলো না। কারণ তাকে সময় দেওয়া উচিত অপ্রিয় সত্য মেনে নেওয়ার জন্য। তিভিহা সকালে নিচে নেমে আসো সে লাহ্দ ওয়ায়েজ ও মরিয়ম বিনকে বলল
" আমার কিছু কথা আছে। "
তারা সহসা বলে উঠলো
" বল আম্মু "
তিভিহা আশ্চর্য হল রাতে সে এত ভাঙচুর করেছে তার ঘরে হয়তো একটা জিনিসও বেঁচে নেই ।একটা প্রশ্ন করল না তারা কেন? এত ভালো কেন তারা? তাদের পুএ এত বেপরোয়া কেউ কি বিশ্বাস করবে? করবে নাহ্ তো!
তিভিহা বলল ,
"আমি চাইনা আমার উপর কেউ দয়া দেখাক। আপনাদের ছেলে আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে বেবির কথা শুনে ফিরে আসলে সেটা দয়া ছাড়া আর কিছুই না ।দয়া করে ফিরে আসবে সেটাই আমি চাইনা। আমার আমার বেবির কারোরই প্রয়োজন নেই। তাই যেদিন এবাড়ীর কেউ নিজ থেকে আমার বাচ্চার কথা তাকে জানাবে সেদিন আমার এই বাড়ীর শেষ দিন হবে ।"
তিভিহার কথা শুনে লাহ্দ ওয়ায়েজ ও মরিয়ম বিন আঁতকে উঠে এত বড় সিদ্ধান্ত!
তিভিহা তাদের মুখবিহর দেখে বলল
"আমার আরো কিছু বলার আছে"
"বলো আম্মু "
লাহ্দ ওয়ায়েজ আম্মু ছাড়া কথাই বলে না তিভিহার সাথে ।
"বেবি হয়ে যাওয়ার ভার্সিটির সাথে সাথে আমি জ#ব করতে চাই প্লিজ আপনার না করবেন না। "
এবার মারিয়া মরিয়ম বিন হেসে উঠলো
"বো*কা মেয়ে আমরা না করব কেন "
লাহ্দ ওয়ায়েজ বলল
"তোমার কষ্ট হয়ে যাবে না ?"
"আমি ম্যানেজ করা শিখতে চাই আব্বু"
"ঠিক আছে আমার আম্মু যা চায়
তাই হবে।"
No comments: