আমার_অভিমানে_শুধু_তুই
পার্ট ৮
দুপুরের খাবার টেবিলে আজ বেশ জমায়েত। হাসাহাসি, গল্পগুজব—সবই চলছে, মূলত নাফিসকে ঘিরে। সে সবার সঙ্গে মিশে গেছে যেন বহুদিন পর ঘরে ফিরে আসা কোনো প্রিয় অতিথি।
জায়ান একদম চুপচাপ। তার সামনে খাবার পরিপাটি করে সাজানো, কিন্তু সে শুধু চামচ নাড়াচ্ছে। কপালের মাঝখানে গভীর ভাঁজ। চোখেমুখে বিরক্তি স্পষ্ট।
শুধু একজন নেই—আরজা।
শাহনাজ চৌধুরী খাবার দিতে দিতে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন,
— "কি ব্যাপার? তোমরা তো সবাই এখানে, আরজা কোথায়?"
সেই মুহূর্তেই ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে আরজা। মাথা নিচু, চেহারায় কেমন যেন একটা ক্লান্ত ভাব। চুপচাপ এসে টেবিলের এক কোণে বসে পড়ে। কারো চোখের দিকে তাকায় না।
শাহনাজ চৌধুরী আবার বললেন,
— "কি হয়েছে আরজা? কোথায় ছিলে তুমি?"
আরজা মাথা নিচু করেই বলল,
— "ছোট চাচি, একটু ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম... কখন দুপুর হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।"
এক মুহূর্ত থেমে আবার বলল,
— " দাদী-দাদা কোথায়? খেয়েছে তারা?"
শাহনাজ মমতা ভরা কণ্ঠে বললেন,
— "হ্যাঁ মা, তারা একটু আগে খেয়ে গেছে। তুই এসে খেয়ে নে।"
আরজা আর কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল। মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ।
শাহনাজ চৌধুরী স্নেহভরে ওর প্লেটে ভাত বেরে দিচ্ছিলেন। পাশে বসে থাকা নাফিস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আরজার দিকে। মুহূর্তখানেক পর আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— “দেখছিস আরিয়ান! আমি এত বছর পর দেশে ফিরলাম, টেবিলে বসে আছি, কেউ একবার তাকালও না। আমার দুঃখটা শুধু আল্লাহ জানে!”
এই বলে সে চোখ টিপে সরাসরি আরজার দিকে তাকাল।
চিরচেনা সেই স্বরটা কানে যেতেই আরজা চমকে মাথা তোলে। যেন হঠাৎ বহুদিনের অপেক্ষার অবসান!
চোখ মেলে তাকাতেই দেখে, নাফিস ঠিক তার পাশেই বসে আছে।
— “নাফিস ভাই!” আরজা আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলে উঠল, “আপনি কখন আসলেন? আমাকে ডাকেন নাই কেনো? আপনি জানেন আমি আপনাকে কত মিস করছি!”
ওর চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ছে। যেন চারপাশের ভারী নিঃশ্বাসটাও হালকা হয়ে গেল এক নিমেষে।
জায়ান চুপচাপ বসে সব দেখছে। আরজার চোখে সেই উচ্ছ্বলতা, যেটা তার জন্য কোনোদিন ছিল না। বুকের ভেতর কোথাও গরম হাওয়ার ঝাঁপটা লাগে জায়ানের। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না, শুধু চোখে জ্বলন্ত অভিমান আর বিরক্তির রেশ স্পষ্ট।
নাফিস হেসে বলল,
— “আরে রে রে, আমার কেশবতী! তোর ঘরেই আগে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি রাজকুমারী ঘুমোচ্ছে! তাই ডাকি নাই। ভাবলাম, ঘুমটা তোরই দরকার।”
এই বলে ওর কপালে এক চট করে হালকা টোকা দেয়।
তারপর হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে বলল,
— “এই! তোর শরীর তো গরম! এদিকে তাকাও... তোর চোখ-মুখ ফুলে গেছে কেন? মনে হচ্ছে তোকে জ্বর এসেছে!”
আরজা মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলল,
— “হয়তো... হয়েছে…”
পাশ থেকে রেহানা চৌধুরী উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন,
— “হাতে ব্যথা পেয়েছে না আজ সকালে। ওটা থেকেই মনে হয় জ্বর এসেছে। জায়ান, বিকেলে আরজাকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাস।”
জায়ান কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই নাফিস বলে উঠল,
— “বড় মামি, আমি নিয়ে যাবো আরজাকে। আমার কোনো সমস্যা নেই।”
এই বলে সে চোখ টিপে তাকায় জায়ানের দিকে। যেন নীরব কোনো যুদ্ধের ঘোষণা!
আরজা এবার তাকাল জায়ানের দিকে। জায়ানের চোখ লালচে, চোয়াল শক্ত। তাকিয়ে আছে তার দিকেই, গভীর, কঠিন, অভিমানী দৃষ্টিতে।
আরজার বুক ধক করে উঠল। সে বুঝে উঠতে পারছে না, কেন এত রাগ জায়ানের চোখে। ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। তারপর নিচু স্বরে বলল,
— “বড় চাচি, আমি নাফিস ভাইয়ের সাথে যাবো?”
রেহানা চৌধুরী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
— “ঠিক আছে মা, যাও। জ্বর নিয়ে আর দেরি করিস না।”প
চারপাশে খাবার নিয়ে হালকা ব্যস্ততা পড়ে গেল। কিন্তু আরজা চুপচাপ বসে আছে। কীভাবে খাবে? শরীর খারাপ, মনও ভারী।
ঠিক তখনই সামনে ভাতভর্তি হাত ধরে কেউ ইশারা করল। আরজা তাকিয়ে দেখে, নাফিস ওর দিকে ভাত ধরে রেখেছে। চোখে-মুখে আদরের ছায়া।
আরজা মুচকি হেসে ভাত মুখে পুরে নিল।
পাশ থেকে সায়মা, আরিয়ানা, সায়েম, জিয়ান একসাথে বলে উঠল,
— “ওহহোও!”
তারপর সবাই হেসে উঠল একসাথে।
শুধু জায়ান, নিঃশব্দ। মুখটা পাথরের মতো শক্ত করে বসে রইল। ভিতরটা তার দাউদাউ করে জ্বলছে, কিন্তু সে কিছু বলল না।
দুপুরটা হাসি-মজায় কেটে গেল সবার, কিন্তু জায়ানের ভেতরে যেন এক নিঃশব্দ ঝড় বইতে লাগল…
বিকেলটা যেন কেমন থমথমে। তাপমাত্রা বেড়েছে আরজার শরীরে, তার সাথে শরীরের ক্লান্তি আর মানসিক দুশ্চিন্তা মিলে অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলেছে।
রেহানা চৌধুরী এসে দেখে গেছেন ওর জ্বর। তৎক্ষণাৎ নাফিসকে বললেন,
— “তুই তাড়াতাড়ি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা, নাফিস। কোনো দেরি করবি না।”
আরজা একটা থ্রিপিস পরে , মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে রেখেছে — যেন চারপাশের চোখ থেকে নিজেকে আড়াল করতে চায়। চোখে শুধু হালকা কাজল, সেটাও পড়েছে অনিচ্ছায় — নাফিস জোর করেছিল বলেই।
নিচে নাফিস দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
আরজা দাদী আর বড় চাচির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচু মাথায় আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল। পায়ে যেন ক্লান্তির ভার, মনে এক অজানা শঙ্কা।
হঠাৎ...
কেউ একজনের বুকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে প্রায় পড়ে যেতে যাচ্ছিল সে।
ঠিক সেই মুহূর্তে কোনো এক শক্ত হাত ওর কবজিতে চেপে ধরে সামলে নিল। আরজা ভয়ে চোখ তুলে তাকাল... তারপরই বুক ধক করে উঠল।
জায়ান!
চোখে আগুন জ্বলা দৃষ্টি, মুখে রাগে থমথমে নীরবতা। সেই অভিন্ন, ঠান্ডা অথচ পোড়ানো চাহনি।
আরজা তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই টের পেল—ওর হাত কেউ শক্ত করে চেপে ধরে আছে।
জায়ান।
আরজার গলাটা শুকিয়ে এল, ভয়ে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
— “ভ... ভাইয়া… আমার ভুল হয়ে গেছে… আমি… আমি দেখিনি… আর কখনো হবে না… সত্যি বলছি…”
কিন্তু জায়ান ওর কথায় কোনো কর্ণপাত না করে, আরও শক্ত করে চেপে ধরল ওর হাত। এতটাই শক্ত, যে ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি পড়ে গেল আরজার।
ঠান্ডা কিন্তু কঠিন কণ্ঠে জায়ান বলল,
— “এইভাবে সাজগোজ করে কোথায় যাচ্ছিস? তোকে বলেছি না—এইভাবে সাজবি না? কথাটা কানে যায় না তোর?”
তারপর চোখে তীব্র অবজ্ঞা নিয়ে বলল,
— “তুই কি ভাবিস, সাজলে সুন্দর লাগে? একদম না। তোকে মানায় না এইসব সাজ! খুবই বাজে লাগছে তোরে!”
আরজা থমকে গেল। কিছু বলল না। শুধু মনে মনে ভাবল—সে কোথায়ই বা সাজল! শুধু একটু কাজল, তাও পরেছিল শুধু নাফিস ভাইয়ের কারণে।
চোখের পানি ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে কিন্তু সে কোনো প্রতিবাদ করছে না। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে সহ্য করছে।
ঠিক তখনই পিছন থেকে নাফিসের গর্জন শোনা গেল,
— “জায়ান! ওর হাত ছাড়! ওর হাতে ব্যথা আছে!”
জায়ান ধীরে ধীরে নাফিসের দিকে ঘুরে তাকাল, ঠোঁটের কোণে কেমন একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি। তারপর যেন জেদের বশে আরজার হাতটা আরও জোরে চেপে ধরল।
আরজা এবার কুকরিয়ে উঠল, ব্যথা আর অপমানে।
সেই মুহূর্তে নাফিস এগিয়ে এসে ওর হাত জায়ানের থেকে ছাড়িয়ে নিল। আলতো করে আরজাকে নিজের পাশে এনে দাঁড় করিয়ে বলল,
— “কে বলেছে সাজলে আমার কেশবতী ভালো লাগে না? অবশ্যই ভালো লাগে। একটু কাজলে আমার কেশবতীকে যেন নতুন লাগে! যা কোনো সুন্দরী মেয়েকেও লাগে না।”
তারপর ধীরে ধীরে জায়ানের একদম কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “ওর কাছ থেকে দূরে থাক। ওকে কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবলেও আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। বলে দিলাম।”more...
তারপর সে আবার আরজার দিকে ফিরল, মুচকি হেসে ওর খোঁপা খুলে দিল।
আচমকা চুলগুলো ছড়িয়ে পড়তেই আরজা বিস্ময়ে তাকাল নাফিসের দিকে। ওর চোখে কিছু একটা ছিল — এক অদ্ভুত নিরাপত্তা, আর একটা শ্লেষ যেন জায়ানের উদ্দেশ্যে।
নাফিস হেসে বলল,
— “চল, আজ শুধু ডাক্তারের কাছে নয়, তোকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।”
এই বলে ওর হাত ধরে বেরিয়ে পড়ল।
আরজা একবার পেছনে তাকাল... চোখে চোখ পড়ল জায়ানের সঙ্গে। সেই দৃষ্টি যেন আগুন ছড়াচ্ছে বাতাসে। এতটাই রাগ, এতটাই অভিমান, যেন সব কিছু জ্বালিয়ে দেবে সে।
আরজা ভয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
জায়ান দাঁড়িয়ে রইল, ঠায়। কিছু বলল না। তারপর ধীরে ধীরে নিজের রুমে ফিরে গেল।
দরজা আটকে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে সিগারেট ধরাল একটার পর একটা। ধোঁয়ায় নিজেকে হারাতে চাইছিল, কিন্তু পারল না।
চোখে রক্তিম রাগ, আর বুকের ভিতর থেকে ফিসফিস করে উঠল,
— “তোর গায়ে অন্য কারোর স্পর্শ… আমি সহ্য করবে না। কখনো না…
তোর হাসি, তোর চোখের কাজল…
সবই আমার…
তুই শুধু আমার।
তোর ওপর কারো অধিকার আমি মানি না…
তোর সব কিছু আমার…”
চোখের কোণে জমে উঠল অচেনা এক ফোঁটা জল। জায়ান চাইলেও লুকাতে পারল না নিজের কাছে…
চলব more....
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টি দেখবেন। প্রথমবার গল্প লিখতেছি। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন। কেউ গল্প পড়লে প্লিজ লাইক কমেন্ট করবেন। এতে আমি গল্প লেখার আগ্রহ পাবো)
No comments: