সন্তান
আমার চিৎকারের আওয়াজে পাশের রুম থেকে ছুটে এলেন আমার শশুর। চোখ বন্ধ হওয়ার আগে শুধু দেখলাম উনি মা মা বলে আমার কাছে ছুটে এসে দুহাতে আগলে নিলেন আমায়।
জ্ঞান ফিরলো অপারেশনের পর। এই পুরোটা সময় বাবা আমার সাথেই ছিলেন। আমার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। আমাকে যখন বেডে শিফট করা হলো তখন বাবা এলেন আমার সাথে দেখা করতে। আমার মেয়েকে তখন ও অবজারভেশন রাখা হয়েছে। কারণ ডেলিভারির সময় অনেক কমপ্লিকেশনস দেখা দেয়।
বাবা এসেই জিজ্ঞেস করলেন,
_ এখন কেমন লাগছে মা ?'
আমি মুচকি হেসে মাথা দোলালাম। উনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
_ চিন্তা করিস না, কেউ না থাক, আমি আছি তোর পাশে। সবসময় থাকবো।'
_ আকাশ আসেনি?'
আমার প্রশ্নে শুনে বাবার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো। তিনি মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
_ তারা তাদের নতুন বউকে নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি চাই ও না ও এখানে আসুক। তুই কি এতো কিছুর পরেও চাস, যে ঐ জা'নোয়ার টা এখানে আসুক?'
আমি কিছু বললাম না। বাবা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
_ শোন মা, মেয়ে হয়েছিস বলেই যে তোকে ওদের গলগ্ৰহ হয়ে থাকতে হবে এটা কিন্তু নয়। মেয়ে বলে কি তুই দুর্বল? না! আমি বলছি শোন, ঐ জা'নোয়ার টার সাথে আর সম্পর্ক রাখিস না। ওর কাছে থাকলে সারাজীবন কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবি না।'
আমি কান্না ভেজা কন্ঠে বাবাকে বললাম,
_ তাহলে আমি কোথায় যাবো বাবা? তুমি তো জানোই, আমার পরিবারের কি অবস্থা। মেয়েকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো!'
_ সে চিন্তা তোকে করতে হবে না। এবার যা করার আমিই করবো। আমার নাতনির জন্য যা করতে হয় সব আমি একা করবো। কাউকে প্রয়োজন নেই। ও আমার র*ক্ত, আমার বংশধর! ও থাকবে রাজকন্যার মতো।'
_ কিন্তু বাবা! মা আর আকাশ?'
_ তুই ওসব নিয়ে ভাবিস না। সুস্থ হয়ে ওঠ আগে। আকাশের মা ভুলে গেছে, এই বাড়ি-গাড়ি, ধন-সম্পদ এখনও আমার নামেই আছে।'
বাবা আরোও কিছু কথা বলে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। কিছুক্ষণ পর আমার বাবা মা ও এসে পৌঁছালো। কতদিন পর দেখলাম তাদের। আমার শশুর তাদের সবটা জানিয়েছেন। মা এসে আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
_ এতো কিছু হয়ে গেছে তোর সাথে তুই আমাদের জানাস নি কেনো মা! সব একা একা সহ্য করলি!'
_ তোমাদের কাছে গিয়ে তোমাদের ঝামেলা আর বাড়াতে চাইনি মা।'
_ ঝামেলা? মা-বাবার কাছে সন্তান কখনো ঝা*মেলা হয়? আমরা এখনও এতোটাও অক্ষম হয়ে যাইনি যে তোকে দু বেলা খাইয়ে পরিয়ে রাখতে পারবো না।'
_ এখন তো আমি একা নই মা!'
_ আমি তোকে আর আমার নাতনিকে আমার কাছে নিয়ে যাবো। কাউকে দরকার নেই আমাদের।'
বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মা। পাশ থেকে আমার শশুর বলে উঠলো,
_ উঁহু! আমার মেয়ে আর নাতনি কোথাও যাবে না। ওরা আমার কাছেই থাকবে।'
_ তা হয় না ভাইজান। আমার মেয়েকে আমি আর আপনার ছেলের সংসার করতে দেবো না। ওমন একটা অমা'নুষের কাছে থাকলে মেয়ে আমার শেষ হয়ে যাবে।' ( আমার বাবা )'
_ আমি ও চাই না ও আকাশের সাথে থাকুক। আমি নিজে ওদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবো। কিন্তু ওদের আমি আপনাদের সাথে যেতে দেবো না।'
_ এটা কি বলছেন ভাইজান। ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর মায়া আপনাদের বাড়িতে কেনো থাকবে! কি পরিচয়ে থাকবে?'
_ কেনো! ঐ যে বললাম, মেয়ে। ও আমার মেয়ের পরিচয়ে থাকবে।'
_ ভাবী সাহেবা বা আকাশ কি তা মেনে নেবে?'
_ ওদের মানা না মানায় কি যায় আসে? বাড়ি আমার, সম্পত্তি আমার। ওরা নাকি গলানোর কে! কেউ না। এটা নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। মায়া মা আমার সাথেই যাবে ব্যাস।' more....
বাবা তার কথায় অটল। শেষমেষ আমাদের সবাইকে তার কথাই মানতে হলো।
৭ দিন ছিলাম হসপিটালে। কিন্তু এই ৭ দিনে আমার শাশুড়ি মা কিংবা আকাশ কেউ আমার সাথে দেখা করা তো দূর, কেউ খোঁজ ও নেয়নি আমি বেঁচে আছি কিনা। আমি বুঝলাম, ঐ মানুষটা আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়। এই কয়দিন আমার শশুর, বাবা , মা সবাই আমাকে বুঝিয়েছে। বলেছে, তার সাথে সম্পর্ক শেষ করতে। আমি ও সেটাই ঠিক করেছি, এবার থেকে আমি বাঁচবো শুধু আমার আর আমার মেয়ের জন্য। তার জন্য ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও নিজের মধ্যে রাখবো না।
আজকে আমাকে হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। বাবা মা চলে গেলেন গ্ৰামের বাড়ি। আমার শশুর আর সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন আমায়। যাওয়ার পথে আমায় মনমরা দেখে বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
_ কি হয়েছে? কি ভাবছিস!'
_ ভাবছি! নতুন বউ নিয়ে নিশ্চয়ই ওরা খুব খুশিতে আছে। সেখানে আমাকে দেখলে কেমন রিয়্যাক্ট করবে! ওদের খুশিটাই নষ্ট হয়ে যাবে।'
_ যাই হয়ে যাক, তুই কিন্তু কাদবি না। মন শক্ত কর। তোকে দুর্বল পেলে ওরা আরোও আঘাত করবে। কথায় বলে না, মানুষ ভেঙে যাওয়া বাড়ির ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়। শুধু মনে রাখবি, যে তোর ভালোবাসার মূল্য দেয় না তাকে ভালোবাসা টা নেহাৎই বোকামি।'
বাবা চুপ করলেন। ভাবলাম, হয়তো তিনিই ঠিক বলছেন, আমার এটাই করা উচিত। কিন্তু, এতো বছরের সংসার, ভালোবাসা, তার প্রতি জমে থাকা মায়া, এতো সহজে কি ভুলে যাওয়া সম্ভব!!'
বাড়ি পৌঁছে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। বাবা কলিং বেল চাপলেন। আমার বুকের ভিতর টা ঢিপঢিপ করছে। কে জানে কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তার নতুন বউ এসেছে। অন্য কারো সাথে সে এতো দিন থেকেছে, শুয়েছে। আমার ঘরে, আমার বিছানায়। আমার সাজানো সংসার টা এখন অন্য কারো দখলে। এসব ভাবতেই চোখ টা ভিজে উঠলো।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা মেয়ে এসে দরজা খুললো। মেয়েটাকে এর আগে কখনো দেখিনি। পোশাকআশাক দেখে মনে হচ্ছে কাজের মেয়ে। সে বাবার দিকে চেয়ে বললো,
_ তখন থেকে বের বাজাইতেছেন ক্যান? কেডা আপনে? কারে চাই?'
_ তুমি কে?'
_ আমি কেডা এইয়া জায়না আপনে কি করবেন? আপনে কেডা তাই কন!'
_ তোমার তো সাহস কম নয়, আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছো আমি কে? এই কে তুমি? কে রেখেছে তোমায় এ বাড়িতে? বেয়াদব মেয়ে! সরো সামনে থেকে।'
বাবা ওকে সরিয়ে দিয়ে আমায় নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। উপর থেকে শাশুড়ি মা, আকাশ আর সাথে একটা মেয়ে নেমে এলো। এটাই হয়তো তার নতুন বউ। বেশ মিষ্টি দেখতে। আমি দুচোখ ভরে দেখে নিলাম তাকে। কি এমন আছে তার মাঝে যে দুদিন এসে আমার এতো বছরের ভালোবাসা টাও ফিকে করে দিলো!'
শাশুড়ি মা চিৎকার করে বললেন,
_ এই ফুলি, এতো চিৎকার চেঁচামেচি কিসের?'
মেয়েটা তড়িঘড়ি বলে উঠলো,
_ দেখেন না গিন্নি মা, এই লোকটা বলতেছে এইডা নাকি হের বাড়ি। কইয়া আমারে ধাক্কা দিয় ভিতরে ঢুকে গেছে।'
_ কে! ও,, তুমি এসেছো। তা এতো দিনে ফেরার সময় হলো বুঝি! সাথে করে আবার এই আপোদ টাকেও নিয়ে এসেছো! আমি তো জানতাম।'
_ এই মেয়েটা কে?'
_ ওকে আমার নতুন বউমার দেখাশোনার জন্য রাখা হয়েছে।'
বুকের ভেতর টা কেমন করে উঠলো। আসতে না আসতেই তার জন্য এতো কিছু! অথচ আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, আমি আসার পর এ বাড়িতে যত কাজের লোক ছিলো আমার শাশুড়ি সবাইকে একে একে বারে করেছিলেন। সে বলেছিলো,
_ ছেলে বিয়ে করে বউ এনেছে। এখনও কাজের লোকের হাতের রান্না কেনো খাবো! বাসায় যেখানে যা কাজ আছে সব ও করবে।'
আর নতুন বউ ঘরে আসতেই কাজের লোক রেখেছেন তিনি। কিন্তু আকাশ! এতোক্ষণ হয়ে গেলো আমি ফিরলাম, সে এসে আমায় একটা বার জিজ্ঞেস ও করলো না আমি কেমন আছি, মেয়ে কেমন আছে! আচ্ছা এটা তো ওর ও সন্তান! ও এতোটা স্বার্থপর কি করে হতে পারে!'
শাশুড়ি মা বললেন,
_ শোনো, তোমায় একটা কথা পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি, এই মেয়ে এই বাড়িতে আর থাকতে পারবে না। আমার ছেলের নতুন বউয়ের পছন্দ নয়। তাই ওকে চলে যেতে বলো, ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আর যেখানে যত টাকা লাগে সেটাও দেবো। কারণ এই ছোটলোক টা আমার ছেলেটাকে তো টাকার জন্যই ফাসিয়ে বিয়ে করেছে। আবার ভোলা ভালা ছেলেটা বুঝতেও পারেনি। ওকে ওর চাহিদা মতো টাকা দিয়ে দেবো, শুধু আমার ছেলের জীবন থেকে আর এই বাড়ি থেকে বরাবরের জন্য ছেড়ে চলে যেতে হবে। ওর মুখ ও দেখতে চাই না আমরা। '
আকাশ এখনও চুপ করেই রইলো। কোনো প্রতিবাদ করলো না। মাকে বোঝালোও না। সে তার হাবেভাবে বোঝালো, তার মা যা বলছে সেও এটাই চায়।
বাবা এবার তার দিকে চেয়ে বলে উঠলেন,
_ সেটা তো আমি ঠিক করবো। কে এই বাড়িতে থাকবে, আর কে বেরিয়ে যাবে।'
চলবে more.....
No comments: