শুধু_তুই
রমনা বেগম বিরক্ত মুখে সোফায় বসে আছেন। রাত বাজে আড়াইটা। ছেলের এখনও ফেরার নাম নেই। গত দু'দিন তাকে চোখে দেখেনি। আজকে শান্তাকে বারবার বলে দিয়েছে, সে যেনো বাসায় আসে। তার অপেক্ষায় ই বসে আছে।
দরজায় কলিং বেল বাজলো। রমনা বেগম উঠলেন দরজা খুলতে। বেশ কয়েক কথা শুনিয়ে দেবেন আজ ছেলেকে। দরজা খুলতেই জিয়ান ঢলতে ঢলতে ভিতরে ঢুকলো। গা থেকে ম'দের গন্ধ ভেসে আসছে। রমনা বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকলেন। জোর গলায় বলে উঠলেন,
_ তুই ড্রিংকস করেছিস?'
জিয়ান মুখ তুলে চাইলো মায়ের দিকে। স্পষ্ট দেখতে পেলো না। মাথা নেড়ে বলল,
_ কই না তো! এই যে দেখো!'
বলেই মুখ নিয়ে গেলো রমনা বেগমের সামনে। রমনা বেগম আরোও রেগে গেলেন।
_ যা রুমে যা। খাওয়া দাওয়া তো লাটে উঠেছে। আর যদি ফের এসব ছাইপাশ খাস তোর একদিন কি আমার একদিন। এই রহিম...!'
রমনা বেগমের ডাকে ভেতর থেকে রহিম বেরিয়ে এলো।
_ জে গিন্নি মা!'
_ তোর ছোট সাহেব কে ভেতরে নিয়ে যা তো। যে অবস্থা, একা একা তো দাঁড়ানোর ও শক্তি নেই।'
_ জে আইচ্ছা গিন্নি মা।'
রহিম ওকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে গেলো।
More.....
••••••
সকাল ১০ টা! জিয়ান এখনও ঘুমিয়ে আছে। সায়রা ব্যালকনিতে হাঁটাহাঁটি করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকা পড়লো। সায়রা দরজা খুলে দেখলো সোহানা দাঁড়িয়ে আছে।
_ নিচে চলো। বড় মা তোমায় ডাকছে।'
সায়রা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রমনা বেগম কিচেনে রান্না করছে। সায়রাকে দেখে তার হাতে এক কাপ কফি ধরিয়ে দিয়ে বললো,
_ যাও মা! এটা তোমার বরকে দিয়ে এসো!'
রমনা বেগমের কথায় সায়রা অবাক হয়ে গেলো। তাকে ওভাবে চেয়ে থাকতে দেখে রমনা বেগম হেসে বললো,
_ কি হলো! এমন করে কি দেখছো? দেখো, ভুল করে হোক আর যেভাবেই হোক, বিয়ে তো তোমার আমার ছেলের সাথেই হয়েছে। তুমি তো এখন আমার বউমা। তাই, এই দায়িত্ব গুলো তো তোমাকেই পালন করতে হবে মা! যাও যাও! ও ঘুম থেকে উঠেই কফি চাইবে। না পেলে রাগ করবে। জলদি যাও।'
সায়রাকে আর কিছু বলতে দিলো না রমনা বেগম। জোর করে পাঠিয়ে দিলো। মুচকি হেসে মনে মনে বললো,
_ কি মিষ্টি মেয়ে! এমন বউমা ই তো চেয়েছি আমি। এত সুন্দর মেয়েকে রেখে আমি ঐ ইঁদুর মুখি টাকে বউমা বানাবো! কিছুতেই না। ও ই হবে আমার বাড়ির বউ।'
~~~
সায়রা জিয়ানের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। কেমন যেনো অসস্থি বোধ হচ্ছে তার। ঢুকবে কি ঢুকবে না এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মনস্থির করলো, ঘরে ঢুকবে সে। বেশিদিন তো নয়, শুধু ৪ টা মাস। তারপর তো এসব তাকে করতে হবে না।
ঘরে ঢোকার আগে ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে নিলো সে। ঘরে ঢুকতেই দেখলো জিয়ান বেডের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সায়রা কফির মগটা টেবিলের উপর রাখলো। জিয়ানের কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললো,
_ শুনছেন! আপনার কফি এনেছি। উঠুন...'
কথা শেষ করতে পারলো না সায়রা। জিয়ান ওর হাত ধরে হেঁচকা টানে ফেলে দিলো নিজের উপর। সায়রা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো জিয়ানের দিকে। জিয়ানের চোখে মুখে তখন ও ঘুম। সে আধখোলা অবস্থায় চাইলো সায়রার দিকে।
_ চুপ! শান্তিতে ঘুমাতে দাও! বিরক্ত কোরো না।'
সায়রা জিয়ানকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ক্ষিপ্ত মেজাজে বলল,
_ লজ্জা করেনা আপনার? এভাবে একটা অচেনা অজানা মেয়েকে স্পর্শ করেন! এটা কি ধরণের অসভ্যতা!'
জিয়ানের ঘুম ঘুম ভাব উড়ে গেলো। সে উঠে বসে সায়রার দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
_ কে তুমি? আমার বাড়িতে এসে আমার রুমে দাড়িয়ে আমায় সভ্যতা শেখাচ্ছো?'
_ ভদ্রতা সভ্যতা না জানলে আমাকে শেখাতে হবে বইকি।'
জিয়ান উঠে দাঁড়ালো। একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকলো সায়রার দিকে। সায়রা পিছিয়ে যেতে লাগলো। জিয়ান ওর হাত চেপে ধরলো দেয়ালের সাথে। চোখ দুটো দিয়ে খুব ভালো করে পরখ করতে লাগলো সায়রাকে।
_ জায়িন ফারিস চৌধুরীকে তুমি সভ্যতা শেখাবে? তোমার মতো মেয়ে আমার বাড়ির কাজের লোক হওয়ার ও যোগ্যতা রাখে না। আর তুমি আমার রুমে এসে আমায় ভদ্রতার পার্ট পড়াচ্ছো! গেট আউট অফ মাই রুম!'
ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো সায়রাকে। সায়রা রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। হাতটা এখনও জ্বলছে। মানুষ নাকি দৈ'ত্য! এতো জোরে কেউ চেপে ধরে! রাগে গজগজ করতে লাগলো সায়রা!
_ আমার বয়েই গেছে তোর রুমে ঢুকতে। নিজেকে কি ভাবে কে জানে। একটু অপেক্ষা করুন মি. জিয়ান ফারিস চৌধুরী, আপনার এই দম্ভ যদি আমি না ভাঙতে পারি তবে আমার নাম সায়রা নয়! এতো অহংকার আপনার! সব ভেঙ্গে চূর্ণ করে দেবো।"
*****
শান্তা ছুটছে দ্রুত গতিতে। আজ দেরি হয়ে গেছে তার। দৌড়ে আসতে গিয়ে ধাক্কা খেলো শাওনের সাথে। শাওন পড়ে যাওয়ার আগেই ধরে নিলো শান্তাকে।
_ কি ব্যাপার মিস! অম্বল হয়েছে নাকি! এতো জোরে ছুটছেন কেনো! মনে হচ্ছে একটু দেরি হলেই..বেরিয়ে যাবে!'
দুষ্টু হেসে বললো শাওন। শান্তা রেগে গেলো। চিৎকার করে বললো,
_ আমার অম্বল হোক আর কম্বল হোক তাতে আপনার কি মশাই! হাড়ে বজ্জাত লোক! সরুন সামনে থেকে!'
_ আপনি তো দেখছি ভীষণ স্বার্থপর। আমি আপনাকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচালাম, কোথায় আমাকে ধন্যবাদ দিবেন তা না, উল্টে ঝগড়া করছেন আমার সাথে!'
_ অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আমাকে বাঁচিয়ে আমার গোটা জীবন টা উদ্ধার করে দিয়েছেন, তার জন্য সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার উপর। আর কখনো আমায় বাঁচাতে আসবেন না! কেমন? যত্তসব!'
শান্তা মুখ বাঁকিয়ে বাড়ির ভিতরের দিকে যেতে লাগলো। ঠিক তখনই বাঁধলো এক বিপত্তি। মালি তখন বাগানের গাছে পানি দিচ্ছিলো। পানিতে ভরে গেছে আশপাশ। ভিতরে যাওয়ার পথেও পানি জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। শান্তা সেটা খেয়াল করেনি। কয়েক পা যেতেই ধপাস করে পড়লো সেই পানির উপর। পিছন থেকে শাওন এসব দেখে হো হো করে হেসে উঠলো।
_ ও মা গোওও! কোমর টা বুঝি এবার ভেঙেই গেলো। বদমাইশ লোক! আমার এই অবস্থা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছেন! আপনার ঐ দাঁত একটাও থাকবে না। সব পড়ে যাবে। খেতে পারবেন না আপনি। না খেয়ে শুকিয়ে ম'রবেন।'
_ আমি আবার কি করলাম!'
_ আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে হাসছেন কেনো? আমায় এসে হেল্প তো করতে পারেন নাকি!'
_ না বাবা! আর হেল্প করার দরকার নেই। আমার ঘাট হয়েছে। একটু আগে হেল্প করে যে কথা শুনিয়েছেন! আমি আর যাচ্ছি না আপনাকে হেল্প করতে!'
_ ঠিক আছে ঠিক আছে, আপনার হেল্পের আমার দরকার ও নেই। হুহ!'
কোনো রকমে উঠে দাঁড়ালো শান্তা। প্যান্ট টা ভিজে গেছে তার। ধীরে ধীরে বাড়ির মধ্যে ঢুকলো। ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখলো উপর থেকে জিয়ান শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে আসছে। শান্তাকে এই অবস্থায় দেখে বললো,
_ কারো সাথে কুস্তি করছিলে নাকি! এই অবস্থা কেনো তোমার!'
_ স্যার পড়ে গেছি!'
_ কোথায় পড়েছো!'
শান্তা বললো তাকে।
_ ঠিক আছে। আমি অফিসে যাচ্ছি। তুমি চেন্জ করে তারপর এসো। মিটিং আছে আজ। এই অবস্থায় তো যেতে পারবে না।'
শান্তা বিরস মুখে মাথা দোলালো। জিয়ান চলে যেতেই রমনা বেগম এলেন সেখানে।
_ তোর এ অবস্থা কেনো?'
_ আর বোলো না তো! ভিতরে ঢুকতে গিয়ে স্লিপ করে পড়ে গেছি।'
_ আহারে! একটু দেখেশুনে ঢুকবি না!'
_ ওসব ছাড়ো! শুনলাম জিয়ান স্যারের বউ এসেছে!'
একগাল হেসে রমনা বেগম বললেন,
_ হ্যাঁ!'
_ কেমন দেখতে গো!'
_ ভীষণ মিষ্টি! গিয়ে দেখে আয়! ঐযে ঐ রুমটাতে আছে!'
_ না থাক! আজকে দেরি হয়ে যাচ্ছে, মিটিং আছে। পরে দেখা করবো।'
_ আচ্ছা, সাবধানে যাস! আবার আছাড় খাস না!'
_ তুমিও...!'
মুখ টিপে হাসলেন রমনা বেগম।
more.....
*****
জিয়ান অফিসে বসে কাজ করছে। শান্তা আসেনি এখনও। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হলো। জিয়ান মুখ না তুলেই বললো,
_ কামিং!'
মেহু রুমে ঢুকেই হাতে রাখা পার্স টা ছুড়ে দিলো জিয়ানের দিকে। জিয়ান হতচকিত হয়ে বললো,
_ শান্তা এটা কি.... তুমি?'
_ হ্যাঁ আমি! তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে রেখে অন্য মেয়েকে বিয়ে করার!'
জিয়ান সোজা হয়ে বসলো। নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
_ তাকে ভালো লেগেছে, তাই বিয়ে করেছি।'
_ জিয়ান! তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো তুমি অলরেডি আমার সাথে এনগেজড! অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারো না তুমি।'
_ বোকা মেয়ে! তোমার কোনো আইডিয়া নেই এই জিয়ান ফারিস চৌধুরী কি করতে পারে!'
_ আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তুমি ভুলে যাচ্ছো!'
_ ছোট বেলায় স্মৃতিশক্তি প্রখর হওয়ায় পুরষ্কার পেয়েছি আমি। আর তুমি বলছো আমি ভুলে যাচ্ছি! আমার স্মৃতিশক্তি দুর্বল! দিস ইজ ভেরি ব্যাড!'
_ জিয়ান...!'
চিৎকার করে উঠলো মেহু। জিয়ান পাশ থেকে একটা সাদা পেপার তুলে নিলো। সেটা হাতের মুঠোয় চেপে মেহুর মুখ চেপে ঢুকিয়ে দিলো তার মুখের ভিতর। মেহু হতবাক হয়ে গেলো জিয়ানের এমন কাজে।
_ হুশশশ! আমার সামনে চিৎকার নয়। উচ্চ স্বরে কেউ আমার সাথে কথা বলুক সেটা আমার পছন্দ নয়। গলা নামিয়ে!'
মেহু ধাক্কা দিয়ে জিয়ান রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মেহু তাড়াতাড়ি কাগজ টা বের করে পাশে রাখা গ্লাসের পানিটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিলো। হৃৎপিণ্ডটা এখনও লাফাচ্ছে তার তীব্র গতিতে। এটা কি মানুষ,, নাকি সাইকো!'
No comments: