#লাল_শাড়িতে_প্রেয়সী
চারদিকে কেমন অদ্ভুত একটা চাপা গুঞ্জন। ছেলেমেয়েরা সবাই ভিড় করেছে ক্লাস রুমের সামনে, যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে। রিদিকে দেখেই ভিড় সরে গেলো, যাতে রিদি সহজে এগিয়ে যেতে পারে। অবাক চোখে সে চারপাশ দেখে আরো বেশি বিস্মিত হলো। যখন দেখলো, ছেলেরা একে একে তার হাতে লাল গোলাপ ধরিয়ে দিচ্ছে। এক জন, দু'জন, তিন'জন এভাবে ধীরে ধীরে যেন এক অদ্ভুত খেলা শুরু হলো। রিদি আর আনিকা, আহিয়া তো হতবাক। আনিকা ফিসফিস করে বললো,
“দোস্ত, এটা কি হচ্ছে? তোকে তো মনে হচ্ছে কুইন বানাইছে এরা!“
নীলা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বললো,
“মনে তো হচ্ছে পুরো কলেজই তোর ফ্যান হয়ে গেছে।“
রিদি হকচকিয়ে চারদিকে তাকিয়ে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেলো। ক্লাসের ভিতরে ঢুকতেই এগিয়ে এলো তামিম। তার হাঁটার ভঙ্গিটাই ছিলো আলাদা, রহস্যময়। দু’হাত পিছনে রাখা, চোখে যেনো অন্যরকম এক দৃঢ়তা। সোজা রিদির সামনে এসে থামলো। কয়েক সেকেন্ড কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে রইলো তার দিকে। রিদিতা ভ্রু কুচঁকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“তামিম! কি হচ্ছে এসব!“
তামিম একটু দ্বীধাবোধ করে, অতঃপর সাব্বিরের দিকে একবার তাকিয়ে স্পষ্ট করে বলে,
“রিদিতা, আমি এখন তোমাকে কিছু বলতে চাই।“
“কি?“
“যদি তোমার আপত্তি থাকে বলো, আমি মেনে নেবো। তবে একটা কথা, বন্ধুত্বটা ভাঙবে না প্লিজ।“
রিদির গলা কেঁপে উঠলো, “মা… মানে…!“
হঠাৎই তামিম তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। চারদিকের ভিড় হাহাকার করে উঠলো বিস্ময়ে। তামিম পিছন থেকে একগুচ্ছ লাল গোলাপ বাড়িয়ে ধরলো রিদির দিকে। সবার চোখ তখন রিদি আর তামিমের উপর। তামিম চোখ বন্ধ করে নরম স্বরে বললো,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি রিদিতা। আই লাভ ইউ.!“
রিদির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। চারপাশে ছেলে-মেয়েরা ফিসফিস করছে। কিন্তু রিদির চোখ যেনো স্থির হয়ে গেছে। সে তো এক মুহূর্তের জন্যও কল্পনা করেনি, তামিম কখনো তাকে পছন্দ করতে পারে! তাকে এভাবে প্রপোজ করতে পারে। সে তো তামিম কে নিয়ে ভাবেইনি কখনো। তার ঠোঁট শুকিয়ে এলো। এক শুকনো ঢোক গিলে সে কিছু বলতে নেয়। কিন্তু তখনই একটা ভারী পুরুষালি কণ্ঠস্বর চারপাশের নীরবতা ভেদ করে উঠলো,
“আই লাভ ইউ টু…“
মুহূর্তেই যেনো বজ্রপাত হলো। তামিম তড়াক করে চোখ খুলে তাকালো, দেখলো আহাদ রাজা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের উপর দু’হাত দু'টো ভাজ করা, চোখদুটো যেন শয়ং অগ্নিশিখা। ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে একেবারে শিকারীর মতো। রিদির বুক ধড়ফড় করছে, শরীর জমে গেছে। তামিম ঘাড় কাত করে তাকালো রিদির দিকে। আহাদের কাঁধের আড়াল থেকে দেখা যাচ্ছে শুধু তার ভীত চোখ। আহাদের উপস্থিতি যেনো তাকে আরো গুটিয়ে ফেলেছে। তামিমের হাত ঘেমে উঠলো। তার নিজেরও বোঝা উচিত, আহাদকে ভয় পাওয়ার মতো কোনো অন্যায় তো সে করেনি? তবুও আহাদের চোখের সেই দৃষ্টি, সেই কর্তৃত্বপূর্ণ ভঙ্গি… অজান্তেই তার শরীর কাঁপতে শুরু করলো। গলাটা শুকিয়ে গিয়ে কাঁপা স্বরে বললো,
“আ… আহাদ ভাই! আপনি?“
আহাদ দাঁত কটমট করে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেনো তামিমের বুকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আহাদ দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠলো,
“ইয়েস! আমি।“
চারপাশে এক নিস্তব্ধতা, সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে এই দৃশ্যের দিকে। চারপাশের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠলো।
যেহেতু ভার্সিটিতে অনেক বড় আকারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তাই শহরের সকল প্রভাবশালী নেতা মন্ত্রীদের ও আমন্ত্রণ করা হয়েছে। তেমনি আমন্ত্রিত ছিল আমজাদ মীর। আশফাক মীর ও আহাদ তার সাথেই এসেছে। প্রশাসন তাদের সম্মানিত করার জন্য স্টেজে তুলে এনেছিল। বক্তিতা কবেলই শুরু হয়েছে এরই মধ্যে শাওন এসে আহাদের কানে কানে খবর পৌঁছায় তামিমের পরিকল্পিত পরিকল্পনার। ঝড়ের বেগে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আহাদ। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের রং বদলে গেল। শরীরের রক্ত যেনো টগবগ করে ফুটে উঠছে।বাদামি চোখ রক্ত বর্ন ধারন করেছে, কপালের শিরা ধপধপ করছে। এক মূহুর্ত দেরি না করে ঝড়ের বেগে বিজ্ঞান বিভাগের দিকে এগিয়ে যায়। শাহীন নাদিম আর শাওন একে অপরের মুখের দিকে তাকায়, অজানা ভয় ও আশঙ্কায় তাদের হাটু কাঁপছে। তবুও তারা আহাদের পিছনে দৌড়ে যায়। আর এসেই সেই অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত চোখে পড়ে। তামিম নিচে হাটু গেড়ে বসে রিদিকে প্রপোজ করছে। আর এটা যেনো আগুনে ঘি ঢালার মত আহাদের উপর প্রভাব ফেলেছে।
এই মূহুর্তে সে রিদিকে তার প্রশস্ত দেহের আড়ালে রেখে তামিমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আহাদের পিছনে থাকা রিদির বুক ধড়ফড় করে কাঁপছে, আনিকা, আহিয়া, নীলা রিদিকে ধরে রিদির একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আহাদ কর্কশ স্বরে গর্জে উঠে,
“কিরে? চুপ করে আছিস কেনো? কিছু বল!”
তামিম হকচকিয়ে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল, চারদিকে একবার তাকিয়ে শুকনো একটা ঢোক গিলে আবার মাথা নিচু করে রাখলো। আহাদ এক কদম এগিয়ে গেলো তার দিকে। তার শক্ত করা মুষ্টিবদ্ধ হাত খুলে গেল নিজ গতিতে। হঠাৎ তার মুখের ভঙ্গি অন্যরকম হয়ে গেলো, মুখে অদ্ভুত হাসি ফুঁটিয়ে তামিমের কাঁধে এক হাত রাখলো। এতে তামিম একটু কেঁপে উঠলো। আহাদ তামিমের হাতে থাকা ফুলের দিকে তাকিয়ে নাটুকে ভঙ্গিতে বললো,
“প্রপোজ করলে ফুলও দিতে হয়। তুই দিলি না কেনো? আমি তো আই লাভ ইউ টু ও বললাম, অথচ তুই খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছিস। নাকি মতিগতি বদলে গেছে তোর!দেখ! এটা ঠিক না, আমি কিন্তু কষ্ট পেয়েছি!”
আহাদকে প্রথমে দেখে সবাই যতটা ভয় পেয়েছে এখন তার নাটুকে ভঙ্গি আর কথা শুনে মুখ টিপে হাসছে সবাই। শুধু শাহীন, নাদিম আর শাওন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ তারা জানে আহাদের এই শান্ত স্বরের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভ'য়'ঙ্ক'র ঝড়। আহাদ তামিমের হাত থেকে ফুলগুলো নিজের হাতে নিয়ে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখতে লাগলো। এরপর নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রান শুকে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“হুমমমম, নাইস!”
এক মূহুর্ত নিরবতার পর আবার বললো, “বাট আই হ্যাভ এ ওয়ান কোশ্চেন?”
তার কথায় তামিম একটু ভ্রুু উঁচিয়ে জানতে চাইলো কি? চারপাশে সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই। আহাদ আরেক ধাপ এগিয়ে এসে কন্ঠ নিচু করে তামিমের কানের কাছে মুখটা নিয়ে হিসহিস করে বললো,
“তোর সাহস কি করে হলো! আহাদ রাজার প্রেয়সীকে প্রপোজ করার মত এতো বড় দুঃসাহস দেখানোর। আমি ভাবছি তোর কলিজাটা কত বড়, যে তুই এই স্পর্ধা দেখালি?”
তামিম আহাদের কথা শুনে একটা শুকনো ঢোক গিললো, এতটুকু সে বুঝতে পেরেছে, যে আহাদ রিদিকে পছন্দ করে কিংবা ভালোবাসে আর সে আহাদের ভালোবাসার মাঝখানে এসে পড়েছে। এতোটা নির্বোধ তো সে নয় যে এই কথার মানে বুঝতে পারবে না। আহাদ এবার একটু দূরে সরে গিয়ে হালকা চিৎকারের ভঙ্গিতে বললো,
“যেহেতু তোর কলিজাটা এতই বড়, এতই প্রশস্ত, একটা কাজ করি। কেটে টুকরো টুকরো করে সবাইকে ভাগ করে দেই, কি বলিস?”
তার এই কথায় সবাই কেঁপে উঠলো, কেউ নড়ছে না। আহাদকে এই মূহুর্তে বোঝা দুষ্কর। কারন আহাদের মুখোভঙ্গি একবার নরম হয় তো মূহুর্তেই আবার অগ্নিলাভা হয়ে ওঠে। তামিম মাথা নিচু করে রেখে, অপরাধীর ন্যায় নিচু স্বরে বললো,
“সরি ভাই! আমি জানতাম না যে আপনি রিদিকে...”
“এহহহহ.! জাস্ট শাট আপ!”
গর্জে ওঠে আহাদ, তার গর্জনে দেয়াল পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। তামিম আর কিছু বলতে পারলো না। শুধু মাথা নত করে আছে। আহাদ কর্কশ স্বরে আবার চেঁচিয়ে উঠে আঙুল নেড়ে বললো,
“যদি তোর কলিজা-গুদ্ধা সব ঠিকঠাক রাখতে চাস, এখনই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। কুইক!”
তামিম অপমান আর অসহায়ত্বের ভারে পা টেনে ঘুরে বেড়িয়ে যেতে নেয়। তবে রিদির পাশে এসে তার পা থেমে যায়। তার বুকটা কেমন চিনচিন করে ব্যাথা করছে। সে তো সত্যি সত্যি রিদিকে ভালোবাসে, অথচ আহাদের ক্ষমতার কাছে সে হেরে গেছে। নিজের ভালোবাসার কথাটা জানাতে এসে এখন অপমানিত হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। তার থেকে তো ভালোছিলো নিজের ভালবাসা প্রকাশ না করা। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। কেনো যে সাব্বির এর কথা শুনতে গেলো! এখন কি রিদি তার সাথে বন্ধুত্ব শেষ করে দিবে? নাকি... নাহ! অন্যকোন প্রশ্নও আসে না। কারন রিদি এখন আহাদ রাজার জীবনের এক গুরুতপূর্ন অংশ। সেখানে অন্য কোন প্রশ্ন থাকাটাও তার জন্য বিলাসিতা। সে শেষ বারের মত চোখ তুলে তাকায় রিদির দিকে, কিন্তু রিদি চোখ নামিয়ে রেখেছে। একবারও তার দিকে ফিরে তাকালো না। হয়তো এটাই হওয়ার ছিলো। সে একটা ব্যাথাতুর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দ্রুত বাইরে বেড়িয়ে যায়। বুকে এক চাপা যন্ত্রণা নিয়ে। আহাদ এবার ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালো শাহীনদের দিকে, চোখে কেমন কঠোরতা। মুখ শক্ত কাঠের মত হয়ে আছে, বা হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা নাকটা ঘষে নিয়ে গর্জে উঠলো,
“শাহীন, নাদিম, দুই মিনিট! দুই মিনিটের মধ্যে আমি এই ক্লাস রুম ফাঁকা চাই। রাইট নাও।”
তার হুকুমের সাথে সাথে নাদিম, শাহীন, শাওন নড়েচড়ে উঠে। সবাই হুড়মুড় করে বেড়িয়ে গেলো। দুই মিনিটের মাথায় পুরো ক্লাসরুম ফাঁকা হয়ে গেলো। শুধু আাহিয়া, আনিকা, নীলা আর রিদি দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে গুটিশুটি মেরে। আহাদ সেদিকে একবার তাকিয়ে হুংকার ছাড়ে,
“তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
আহিয়া কেঁপে উঠে রিদিতার হাত শক্ত করে ধরে, এরপর চারজনই বেড়িয়ে যেতে উদ্যত হয়। তখনই রিদি এক হেঁচকা টানে থেমে যায়, সাথে আহিয়াও। তাকিয়ে দেখে আহাদ রিদির ডান হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। রিদির দিকে জলন্ত দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বলে,
“তোমাকে যেতে বলিনি!”
আহিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো, আহিয়া চোখে বড় বড় করে অবাক হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আহাদ কোন পরোয়া করলো না বরং বিরক্ত হয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
“ওর হাত ছাড় আহি!”
আহিয়া ও এতোটা নির্বোধ না, যে তার সিংহের মতো ভাইয়ের হাতে বান্ধবিকে রেখে যাবে। আহিয়া রিদির হাত টেনে বলে,
“কেনো?”
“কারন আমি বলেছি।”
“সেটাই তো! তুমি কেনো বলেছো?”
“আহিইইইইই.! থাপ্পড়ায়া তোর চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো। তোর এত বড় সাহস তুই আমাকে প্রশ্ন করছিস?”
আহিয়া এবার ভয়ে রিদির হাত ছেড়ে দিলো। রিদির অন্যহাত তখনো আহাদের মুঠোয় বন্ধি। আনিকা তো সব কিছুই জানে, তাই সে আহিয়াকে সামলে নিয়ে বাহিরে বেড়িয়ে আসে। তখনই তাদের মুখের উপর ঠাস করে ক্লাসরুমের দড়জাটা বন্ধ হয়ে যায়। সেই শব্দ প্রতিব্ধনি হয় পুরো করিডোর জুড়ে। ভিতরে কি হচ্ছে তারা জানে না। কেমন আনচান আনচান করছে তাদের মন। কৌতহল চাপতে না পেরে আনিকা আর আহিয়া দরজায় কান পাতার পরিকল্পনা করে, তবে তাদের সামনে গার্ডরা এসে বাধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়ায়। তাদেরকে দেখে শাহীন এগিয়ে এসে আনিকাকে বলে,
“অন্যের পার্সোনাল মূহুর্তে আড়ি পাততে নেই। এতোটুকু অত্যন্ত থাকা উচিৎ। এভাবে কান পাতা ঠিক না, সরে যান এখান থেকে।”
আনিকা শাহীনের উপর খেঁকিয়ে উঠে,
“আমরা রিদিকে না নিয়ে কোথাও যাবো না। আর আমাদের যা ইচ্ছা আমরা তাই করবো তাতে আপনার কি?”
“দেখুন মিস! ভালোয় ভালোয় গেলে ভালো, আর না গেলে আরো ভালো।”
“মানে? কি করবেন আপনি?”
আহিয়া আর নীলা একে অপরের দিকে তাকালো। শাহীন একবার নাদিমের দিকে তাকিয়ে হালকা একটা হাসি দিলো। এরপর এক কদম এগিয়ে এসে আনিকার দিকে একটু ঝুঁকে বললো,
“আমি শুধুু আমার দায়িত্ব পালন করবো। তার জন্য যা যা করেতে হয় সেটাই করবো। বাকি টা আপনি ভালো বোঝেন!”
আনিকা আর বেশি কিছু বললো না। শুধুু বিরক্তিতে কপাল গুছিয়ে নিলো। অতঃপর বাধ্য হয়ে তারা সেখান থেকে বেড়িয়ে চলে গেলো।
★
আহাদ চোখ বন্ধ করে মাথা তুলে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুকের ভেতরে জমে থাকা অগ্নিলাভা ক্রোধটাকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে, অথচ তার চোখের দৃষ্টি বলছে অন্য কথা। ধীরে ধীরে সে রিদির হাত ছেড়ে দিয়ে এক কদম পিছিয়ে দাঁড়ালো। এক হাত বুকে ভাজ করে, অন্য হাত চিবুকে ঠেকিয়ে দু’আঙুল দিয়ে স্লাইস করতে করতে মনোযোগ দিলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেয়সীর দিকে। তার গাঢ় বাদামি ঘন পাপড়িযুক্ত সেই চোখের ধারালো দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মিললো রিদির ভীত চোখের। আহাদের সেই দৃষ্টি এতটাই তীক্ষ্ণ ছিলো যে, রিদি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে নিলো নিচের দিকে।
আহাদ এই প্রথমবার সরাসরি খুব কাছে থেকে তার প্রেয়সীকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখছে। তাও আবার সেই লাল শাড়ি। অথচ এই লাল শাড়ি পরা প্রেয়সীর একটা ছবি তার জীবনটাকে এলোমেলো করে রেখেছে। আর আজ সেই একই দৃশ্য চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝে গেলো তার এলোমেলো জীবনটা আজ আবার ধ্বংসস্তূপে পরিনত হবে। নিজেকে কি করে সামলাতে হবে বুঝতে পারলো না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত গভীর দৃষ্টিতে পরখ করতে লাগলো রিদিকে। মনে হলো, যেন তার সামনে কোন হুরপরি দাঁড়িয়ে আছে। অথচ সেই পরি তার কাছে নিষিদ্ধ, যাকে স্পর্শ করা বারন। বুকের ভেতরে হঠাৎ করেই অকারণে এক তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো।
রিদি না তাকিয়েও বুঝতে পারলো আহাদের দৃষ্টি তার উপর গেঁথে আছে। তার বুকের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তি হলো। তাই সে শাড়ির আঁচলটা তুলে নিয়ে মাথায় টেনে দিলো। মাথায় লাল শাড়ির আঁচল পরতেই তার গালের আভা লাল হয়ে গেলো, এতে আরো মোহনীয় হয়ে উঠলো তার রূপ। আহাদ সেদিকে তাকিয়ে একটা তৃষ্ণার্ত ঢোক গিলে দু’কদম পিছিয়ে গেলো। হঠাৎ করেই সে এক বেঞ্চে সজোরে লাথি মারলো। কাঠের সেই শব্দে পুরো কক্ষে প্রতিধ্বনি হলো। ভয়ে রিদির কোমল দেহখানা কেঁপে উঠলো, চোখ বন্ধ করে নিলো অজানা আশঙ্কায়। মুহূর্তেই আহাদ রিদির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বজ্রকন্ঠে হুংকার ছাড়লো,
“এই আল্লাহর বান্দি এই! তাকাও আমার দিকে!”
রিদি কেঁপে উঠে ভয়ে ভয়ে দৃষ্টি মেললো আহাদের চোখে।
আহাদ হাত নেড়ে ইশারা করে কর্কশ কন্ঠে বললো,
“এভাবে লাল মরিচ সেজে ভার্সিটিতে আসতে কে বলেছে হেহ? আল্লাহর দুনিয়ায় আর কোনো রঙের শাড়ি ছিলো না?”
“ন.. না.!”
“কিহহহ.!”
“না… মানে, আমার তো শাড়ি নেই। বুবু এটা দিয়েছে, তাই এটা পরেই আসছি।”
এক মূহুর্ত নিরবতার পর, রিদি ঠৌঁট শক্ত করে করে আবার বললো,
“আর তাছাড়া আমি লাল মরিচ সেজে আসি আর ঝাঁল মরিচ সেজে আসি! তাতে আপনার কী? আমার যখন যে ভাবে ইচ্ছা আমি সেভাবেই আসবো। কি করবেন আপনি?“
আহাদের দিকে তাকিয়েই কথাটা বললো রিদি, এই কথায় আহাদ আরো ক্ষীপ্ত হয়ে গেলো। আহাদ এবার আরো এক ধাপ এগিয়ে আসে রিদির দিকে। এতে রিদি পিছিয়ে যায়, তার পিঠ গিয়ে ঠেকে দেয়ালের সাথে। আহাদ কাছে এসে ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা তাছিল্যের হাসি দিয়ে গর্জে উঠলো,
“আমার কী হাহ? কী করবো আমি..!”
কথাটা শেষ করতে না করতেই হঠাৎ রিদির দিকে ঝুঁকে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“একটা কথা ভালো করে মগজে বসিয়ে নে জানু!
আমার অনুমতি ছাড়া যদি আর কখনো লাল শাড়ি পরেছিস! তাহলে তোর ওই লাল শাড়ি আমি সাদা কা'ফ'নের কাপড়ে পরিণত করবো!”
তার এই কথায় রিদির বুক ধড়ফড় করে কেঁপে উঠলো। আহাদের আগুন ঝরা চোখের দিকে তাকিয়ে দেয়ালের সাথে শেঁটে গেলো। আহাদ শেঁটে যাওয়া রিদির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দু’আঙুল দিয়ে কপাল চেপে ধরলো, যেনো নিজের ভেতরের অগ্নিকে ঠাণ্ডা করতে চাইলো। অতঃপর একটু সরে এসে ফোন বের করে শাহীনকে কল করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহীন এসে হাজির হলো, হাতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। কোনো কথা না বলে ব্যাগটা আহাদের হাতে দিয়ে আবার বেরিয়ে গেলো। আহাদ ব্যাগটা রিদির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
“এটা পরে নাও। কুইক!”
“কী এটা.!”
রিদি কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে বের করতেই দেখে কালো একটা বোরকা। কপাল কুঁচকে তাকালো আহাদের দিকে। আহাদ তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কর্কশ কন্ঠে ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
“কী দাঁড়িয়ে আছো কেনো? আমি কি বলেছি শুনতে পাওনি? নাকি অন্য ব্যবস্থা করতে হবে?”
রিদি দ্রুত নজর সরিয়ে নেয়। এরপর চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকে নিয়ে শাড়ির আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে নেয়। বোরকা হাতে নিয়ে দ্রুত বোরকা পরে নিলো। এরপর মাথায় হিজাবটাকে ও ভালোকরে পেঁচিয়ে নেয়। আহাদ তার দিকে তাকিয়ে থেকে ঠাণ্ডা স্বরে বললো,
“এবার ঠিক আছে।”
রিদির ঠোঁট জোড়া অভিমানে ফুলে গেছে। কতকষ্ট করে সে শাড়ি সামলে এ পর্যন্ত এসেছে, কত কষ্টে সাজুগুজু করেছে। আর এখন কিনা কালো বোরকা পরে থাকতে হবে তাকে? তার চোখ জোড়া ছলছল করছে। সে মনে মনে স্থির করলো আর এক মূহুর্ত ও সে এখানে থাকবে না। এখনই বাড়ি ফিরে যাবে, দরজার দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে আহাদ প্রশ্ন করে,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“কোথায় আর, বাসায় যাচ্ছি।”
তার গলা কাঁপছে, স্পষ্ট বোঝা গেলো অভিমান জমেছে তার মনে। তবে আহাদেরও কিছু করার নাই। এভাবে লাল শাড়ি পরে তার প্রেয়সী তার সামনে ঘুরে বেড়ালে বড় কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাই তো এসব করতে বাধ্য হয়েছে সে। আহাদ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, এরপর নরম স্বরে বললো,
“ঠিক আছে যাও। শাহীন তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমি যেতে পারবো না, এখানে থাকাটা আমার জরুরি।”
“কাউকেই যেতে হবে না। আমি একাই চলে যেতে পারবো।”
আহাদ এবার কণ্ঠ দৃঢ় করলো, দাঁত পিষে বললো,
“আমি যখন বলেছি শাহীন সাথে যাবে, তার মানে যাবে। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
রিদি বুঝতে পারলো আর উপেক্ষা করেও কোন লাভ নেই। তাই শুধু মাথা নাড়লো। আহাদ সেদিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,
“গুড।”
এই বলে সে শাহীনকে আবারও কল করলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শাহীন এসে রিদিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। দরজার বাইরে হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীর পেছনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আহাদ। বুকের উপর হাত রেখে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যেন একটা ভয়াবহ অঘটন এড়াতে পেরেছে। অতঃপর গম্ভীর মুখে আবার স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো।
★
রিদি একরাশ রাগ, অভিমান আর অস্বস্তি বুকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। নিজের উপরই তার এখন রাগ হচ্ছে, মনে মনে ভাবলো তার যাওয়াই উচিত হয়নি। নিজেকেই এখন দোষারোপ করছে সে। আসার আগে আনিকা, আহিয়াদের সাথেও দেখা করেনি। আর তাছাড়া লাল শাড়ি পরলে আহাদের সমস্যা কোথায় বুঝতে পারলো না! একদিকে নিজের উপর অভিমান, অন্যদিকে অকারণ রাগ আর হাজারো প্রশ্ন নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একধারে কলিং বেল চেপে যাচ্ছে। যেনো সব রাগ ক্ষোভ সব কলিং বেলের উপর ঝাড়ছে। ভেতর থেকে ঈশানীর চেঁচানো কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এই কে বেল বাজাইতেছে এভাবে!”
বলতে বলতেই দরজাটা খুলে দিলো। কিন্তু দরজা খুলেই ঈশানী থমকে দাঁড়ালো। চোখ কপালে উঠলো বিস্ময়ে। কারন যে রিদিকে সে সাজিয়েগুজিয়ে লাল শাড়ি পরে পাঠিয়েছিলো, সে রিদি এখন কালো বোরকা পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ অন্যরকম এক রুপে। মুখ গোমড়া, ঠোঁট ফুলিয়ে রেখেছে, গাল দুটো লালচে হয়ে আছে। কপাল কুঁচকে ঈশানী জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে, কী হইছে তোর? তুই না শাড়ি পরে গেছিলি! তাহলে এইভাবে... কি হইছে হে?”
রিদি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললো,
“ঘোড়ার ডিম.!”
বলেই ধপধপ শব্দ তুলে ভেতরে ঢুকে। জুতাগুলো খুলে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেললো, যেন জুতাও অপরাধী। হিজাব খুলতে খুলতে আচমকা থেমে যায়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখলো ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছেন তার বাবা। চিরচেনা সেই মুখ, ঠোঁটে পরিচিত উষ্ণ হাসি। রিদির বুক কেঁপে উঠলো। অস্ফুট স্বরে বের হয়ে এলো,
“আ… আব্বু!”
তার বাবা হালকা হেসে মৃদু স্বরে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম, আম্মাজান। কি হইছে আপনার? এতো রাগ কিসের উপর!
"ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি কখন আসলা?
তারেক রায়ান হালকা হাসলেন। রিদিতার চোখের কোণ ছলছল করছে, আবেগে গলা ভারী হয়ে গেছে। বাবাকে এতদিন পর হঠাৎ সামনে দেখে ভেতরের সব বাঁধ ভেঙে গেলো। চোখের পানি টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। তারেক রায়ান উঠে এসে মেয়েকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন। কপালে আলতো চুমু খেয়ে নরম গলায় বললেন,
“আহা… কান্না করছো কেনো মা?”
রিদি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কিন্তু কান্নার কারনটা আজকের ঘটনা নাকি তার বাবা! নিজেও বুঝতে পারলো না। তার গলা ভাষ্পে ভরে গেছে, ঠিকমতো কথা বের হয় না। অবশেষে কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এতদিন পরে মনে পড়লো তোমার আমাদের কথা?
আমাকে নিতেও আসলে না, দেখতে আসলে না! এখন হঠাৎ কি মনে করে আসলা। হুম?”
তারেক রায়ান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, চোখে একরাশ মায়া। ঈশানী সোফায় বসে সেদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য মেশানো গলায় বলে উঠলো,
“তোর এসব ভন্ডামির কথাবার্তা বাদ দে। আব্বু তো সেদিনও বলছিলো তোকে নিতে আসবে। তুই নিজেই না বললি এখন যাবি না, সামনে ইনকোর্স আছে! এখন আবার উল্টা-পাল্টা বলতেছিস কেনো?”
রিদি রাগে চোখ বড় বড় করে তাকালো বোনের দিকে, কিন্তু কিছু বললো না। তারেক রায়ান মৃদু হাসলেন, যেন দুই মেয়ের টানাপোড়েনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। দৃঢ় স্বরে বললেন,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি তো এসেছিই তোমাদের নিতে। এখন এসব নিয়ে ঝগড়াঝাটির করার দরকার নাই।”
তিনি এবার রিদির দিকে তাকালেন, ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার বুবু বলছিলো, তোমাদের ভার্সিটিতে নাকি কি অনুষ্ঠান আছে। তাহলে এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?”
রিদি চোখ নামিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো,
“এমনিই… ভালো লাগছিলো না।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও।”
ঈশানী ভ্রু কুঁচকে গভীর দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকালো। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু বাবার সামনে কিছুই বললো না। কারন তাহলে আবার বাবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে রিদিকে। রিদি এক ঝলক ঈশানীর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে গেলো। বোরকা-হিজাব খুলতে খুলতে ফুঁস ফুঁস করে বললো,
“উফ, এই আহাদ রাজা। আমার জীবনডা কইরা দিছে ভাজাভাজা। একটু কিছু হইলেই দেয় সাজা। তার হাত থেকে কেউ আমারে বাঁচা…”
এই বলতে বলতে বোরকা, হিজাব খুলে ছুড়ে মারলো আলনায়। এরপর ধপাস করে বিছানায় বুঁদ হয়ে পরে মুখটা বালিশে গুঁজে দিলো। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো। চাপা কান্না হলেও এত গভীর যে, তার ভেতরের সব অভিমান, কষ্ট আর রাগ যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার বুকের ব্যথা কিছুতেই হালকা হলো না। যেন আহাদ নামের এক ঝড় তার সমস্ত শান্তি কেড়ে নিয়েছে, আর তাকে ফেলে রেখেছে এক অস্থির আঁধারে। অথচ সে ঝড় তার জীবনে সে নিজেই নিয়ে এসেছে!
No comments: